যাজ্ঞসেনী গুপ্ত
খেতে বসে নোটিফিকেশনটা খুলল। একটা লেখা পড়তে ডেকেছে সুকান্ত। সুহৃদ শহীদুল্লাহ্ যাজ্ঞসেনীর বন্ধুতালিকায় নেই। তবে নামটার সঙ্গে পরিচয় আছে। “তরুণ কবিকে বলি” বইটা এবার বইমেলা থেকে সে কিনেছে। অসাধারণ একটা বই, যার পাতা বারবার ওল্টাতে হবে – যারা কবিতার সঙ্গেই বসবাস করে। সুহৃদের সম্পাদনা আর তার মুখবন্ধটাও যেন পাথরপ্রতিমা।
সুতরাং বাম থেকে ডানে আর ডান থেকে বামে শরীরটাতে হালকা একটা মোচড় দিয়ে লেখাতে চোখ বিঁধিয়ে দিল। একটা শব্দও আলগাভাবে নজর পেরিয়ে যেতে না পারে। বিষয়টাও অফবিট; স্কিজোফ্রেনিয়ায় পেড়ে ফেলা জার্মানকবি হোল্ডারলিনকে নিয়ে। তবে শুধু সেই ডালেই মৌকো বেঁধে ফেলেননি সুহৃদ। তাঁকে কেন্দ্রে নিয়ে চারপাশে ছোট্ট করে এঁকে ফেললেন একটা বৃত্ত। হোল্ডারলিনের সমকাল ও তৎকালেও সমসাময়িকদের উপেক্ষার প্রচলিত ধারা – একটা বিন্দু। সেখান থেকে শুরু। টুয়েবিনগেন – যেখানে অসুস্থ পরিত্যক্ত কবিকে নেককার নদীর ধারে নিজেদের গৃহে ভালবাসার আশ্রয় দিয়েছিলেন কাঠমিস্ত্রী এক বাবা ও লোটে নামের তাঁর এক মেয়ে।
একজন শিল্পী সৌধ নির্মাণ করলেন। না, হোল্ডারলিনের নয়, তাঁর আশ্রয়দাত্রী লোটের। আশ্চর্য! জীবদ্দশায় দেশের মানুষ যে অবহেলা কবিকে দিয়েছে একি সেই শোচনার সলজ্জ স্খালনে ভূমিনত হওয়া?
লোটে ও তার বাবা হ’লেন আরণ্যক গাছগাছালির ভেতর দুর্লভ ব্রহ্মকমল, একটা অনন্তমূল। থাকে এমন। সুহৃদও পেলেন হোল্ডারলিনের মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে। গুনতি দিনের আয়ুসম্বল কর্কটরোগী ডোনেটাস মৃত্যুর পরের সমাধিপুষ্প প্রত্যাখ্যান করে তার দামটুকু এইজীবনে সঞ্চয় করেন গরীব বাংলাদেশের গরীব মানুষের জন্য।
কেমন যেন সম্পূর্ণ হয় বৃত্ত। সবারই কাছে কোনো মানুষ উপেক্ষিত হতে পারে না। হোল্ডারলিন মিলিয়ে দিলেন বৈশ্বিক-বৃত্তের দুটি মুখ। সেকাল একাল, কাঠমিস্ত্রী-লোটে ডোনেটাস, হোল্ডারলিন-বাংলাদেশ-সুহৃদ। সবাই তো সবার দিকেই এগিয়ে চলেছে বৃত্তের একটু ফাঁক বুজিয়ে সম্পূর্ণ করতে। যেমন ডাউনলোডের গোল সাইন, বৃত্ত সম্পূর্ণ না হলে যা চাওয়া হয় তা পাওয়া যায় না। দু-এক পা বৃত্তের বাইরে গেলেই এলোমেলো, অতিক্রম করে যাই একে অন্যকে।
ঘরে সে একা। বাইরের কড়া রোদের লালচোখের হাত থেকে মুক্তি পেতে সব দরজা জানালা বন্ধ। একটা ফটিক জল অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে। তার ডাকটা কাছে দূরে আসা যাওয়া করছে। লেখাটা পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু মনে মনে কতকগুলো তরঙ্গ দুলিয়ে দিচ্ছে মনের সেকত ভূমি, বালি সরে সরে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত নির্জন ঘরে শুধু ঘূর্ণায়মান পাখা আর হাতে মাছের কাঁটা। বস্তু আর বাস্তব ছাড়িয়ে গেছে সে ভাব আর পরাবাস্তবে।
খাওয়া শেষ হয়নি তার, মনের ভেতর ঘাই মারছে প্রশ্নমাছ। কীভাবে হোল্ডারলিনকে মনে রেখেছে মানুষ? কীভাবে মনে রাখবে যাজ্ঞসেনীদের? …. যাজ্ঞসেনীকে? আদৌ কি মনে রাখবে? কেনই বা, তেমন কিছু কি বুনে তুলেছে নক্সী কাঁথায়? নাকি শুধুই না-এর কম্পন ছড়ায় পরাঙ্মুখ দেহমনের অস্তিত্ব?
খেতে খেতে হঠাৎ গলায় মাছের মাঝারি একটা কাঁটা আটকে যায় তার। সেটা সামলাতে গিয়ে চর্বিত ভাত শ্বাসনালীতে চলে যায়। খাবার গলা থেকে নামেও না, ওঠেও না। হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। শ্বাসনালী আটকে দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বড় হয়ে যায়। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। জলের গ্লাসটাও কাঁপা হাতের ধাক্কায় উলটে গেল। কেউ জানল না। স্কিজোফ্রেনিয়ার তরঙ্গ ছড়াতে শুরু করল তার সব চেনা মানুষ আর আপনজনের মনে।
ক্ষীণভাবে মৃত্যুর আগে মনে হলো, মরণের এই পদ্ধতির জন্যই তাকে তারা কিছুদিন মনে রাখবে। – হয়তো। এই জন্যই হয়তো মিথ হয়ে যাবে ঘটনাটা, কিন্তু বিস্মরিত হবে সে নিজে। তেমন তো কেউ জানেই না তার দু-চার লাইনের আঁচড়ের ইতিবৃত্ত। তার কি-ই বা দাম? মাটি নেই, সে তো শুধুই বালি। তা দিয়ে কিছু ভাঙাগড়া হয় না।