তানজীনা ইয়াসমিন

কামরায় আলো কিছুটা হালকা। ঝুমুর স্বস্তি পেলো।
এইটুকুও না হলে এত কষ্ট করে আসা আজ নিরর্থক হতো। কিছুই বলা হতো না। পালিয়ে বাঁচতো।
ডাক্তার বোধহয় ফ্রেশরুমে গেছেন।
মিনিটখানেকের বিরতিতে রুমে ঢুকলেন। তাঁর মুখ থেকে আসা তীব্র সিগ্রেটের গন্ধ আবার ঝুমুরকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।
ধুমপায়ীরা এই অস্বস্তি বোঝেনা। ঝুমুর মুখ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে নাক কুঁচকানোটা যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করলো।

সিগ্রেটের গন্ধ সহ্য হয়না? বর, বয়ফ্রেন্ড সিগ্রেট খায় না।
ঝুমুর হ্যা না এর মাঝামাঝি মাথা নাড়লো।

আমার সামনে খায় না।

উত্তরে বুঝিয়ে দেয়া যে, হ্যা , কেউ একজন আছে।
থেরাপিস্টের করা প্রশ্নটার মতই এক ঢিলে দুই পাখি বধ।
তিনি সামনে রাখা গ্লাসের পানি চুমুক দিয়ে কলকুচি করে গন্ধ দূরীকরনের হালকা চেষ্টা করলেন।
চেষ্টাটা ঝুমুরকে স্বস্তি দিল।
তিনি বিষয়টা বোঝেন । না হলে মুখ এদিক সেদিক করে হাতে বাতাস তাড়াতেন , বেফিকির।
ঝুমুর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেনা। এই থেরাপিস্ট খুব এক্সপেনসিভ। ঘন্টা ধরে বিল করেন। অহেতুক ত্যানা প্যাচালে ঝুমুরেরই ক্ষতি।

আমি আসলে আমার সমস্যাটা মোটামুটি এড্রেস করতে পারি । বুঝি । কিন্তু সিদ্ধান্ত যা নিয়েছি বা যা বুঝেছি তা ঠিক কিনা যাচাই করতে একটা থার্ড, না থার্ড না , সেকেন্ড অপেনিওন নিচ্ছি।
থেরাপিস্ট জিজ্ঞাসু চোখে পরের লাইনের অপেক্ষায়।

আমি আসলে আমার ইস্যুটা কাউকেই শেয়ার করিনি। মানে পার্সোনাল ইস্যু, শেয়ার করলে …

আপনাকে খুব খারাপ ভাববে সবাই। আপনি আপনার সেটেলড গুড গার্ল ইমেইজটা নষ্ট করতে চান না, এই ঐ ।? কেউই চায়না। ব্যাড গার্লরাও না। আগে বলুন আপনি বিবাহিত কিনা, বাচ্চা কি এবং সমস্যাটা কাকে নিয়ে?

না, আমি বিবাহিত না। সমস্যাটা যাকে নিয়ে সে যে আমার ঠিক কি তাতে আমি দ্বিধান্বিত।

ডাক্তারের ভ্রূ কুঁচকে গেলো। ঝুমরকে তাঁর বয়সের চেয়ে কোনো অংশেই কম লাগেনা। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বাংগালী মেয়ে অবিবাহিতা খুব বেশী কমন না।

শুরু থেকে বলুন…

মানে , আমি তাঁকে আমার প্রেমিকই ভাবি, বা ভাবতে চাই। কিন্তু আমি দ্বিধান্বিত তাঁর কাছে আমি কি সেই নিয়ে।

আপনার নাম? সংক্ষিপ্ত ফর্ম।
— জী আমার? ঝুমুর।
-ঝুমুর শুনুন। কিছু রুলস লেখা একটা বোর্ড বাইরে টাঙিয়ে রেখেছি, পড়েছেন?
ঝুমুর পড়েছে। রুলসে লেখা ছিল,

যে কথা (বিশেষত নারী হলে) অন্য অনেককে বলে এসেছেন, তা বলার শুরুতে “কাউকেই শেয়ার করিনি, আপনাকেই প্রথম …” বলবেন না।
এটা বাসর রাত না যে সেই লেবেলের বিশ্বস্ততার বিষয় আছে। আছে নির্ভরতার চেয়েও বেশী নির্ভারতার

এটা চার্চের ফাদারের কনফেশন রুম না, যে অপরাধ বোধ মুক্ত হবার স্থান।
আপনার সমস্যা খুলে বলবেন নিজেকে হালকা হতে হলেই, সংশ্লিষ্ট না হলে সেই ঘটনা টানার কোনো আবশ্যকতা নেই।

সিক্রেসী আর প্রাইভেসী – দুটো ভিন্ন টার্ম।
সিক্রেসী মানে এমন কোন পাপ লুকানো যার উপর ভিত্তি করে আজকের সমস্যা , হতে পারে আপনি লজ্জিত , বিব্রত বা ভীত- সেটাই সমস্যার জট।
আর প্রাইভেসী মানে নিজের ব্যক্তিগত স্পেস রাখতে চাওয়া। মনে মনে আপনি কখন কোন লাইন ক্রস করছেন তাঁর ডিটেইল জানানো যার কোনো প্রয়োজন নাই। নিজের পার্টনারকেও না। প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র , একক।

ঝুমুর মাথা নেড়ে জানালো , পড়েছে।

হুম। তাহলে শুরু করুন। স্থির হয়ে গুছিয়ে নিন। একেকবার একেক কথা বলবেন না।
ঝুমুরের ভ্রূ কুচকে গেল।
তার ধারণা ছিল সাইকোথেরাপিস্টরা খুব ঠান্ডা মেজাজের হয়। এর কথা মাস্টার মশাইদের মত।
লম্বা শ্বাস টেনে নিল।
নাহ তাঁর নিজেকে লুকাবার বা ভালো রাখার চেষ্টা ধরার কিছু নাই।
লুকাবার মত এমন গহীন কোনো পাপ তাঁর নাই, যদি পাপ মানে ধরা হয় কারো ক্ষতিসাধন । ক্ষতি যা তাঁর নিজেরই হয়েছে।
-আমার বয়স ৩৭। একটা বড় কর্পোরেটে কাজ করি…

হ্যা বয়স , পেশা এসব তো অনলাইনে ফর্মে পূরণ করেই এপয়েনমেন্ট নিয়েছেন।

ওহ , ভেবেছিলাম পড়েন কিনা।

আমি ক্লায়েন্টের ডিটেইলস আগে পড়েই বসি । . বাই দ্য ওয়ে , বয়স কত বছর কমানো? ১ না ২ ? না বেশী?
ঝুমুর খুবই বিরক্ত হলো। এই থেরাপিস্টের তো মহিলাদের সাথে কথা বলার বেসিক আদবই জানা নাই ! তাঁর প্রশ্নের সুস্পষ্ট অর্থ ঝুমুরকে বয়স্ক লাগে!

১ বছর কমানো । আসলে ৩৮ ।

এখনো বিয়ে করেন নি?

না । আগে ভেবেছিলাম করবো না । পরে ওর সাথে হঠাৎ সম্পর্কটা …… কিন্তু এখন

কি সমস্যা কি?

আসলে আমি আর ও , মানে তমাল একই অফিসে কাজ করি । ও রাজশাহীতে , আমি ঢাকায়। আমরা সমবয়সী। আমাদের যোগাযোগ মূলত ফোনের চেয়েও ফেইসবুক স্কাইপ এসবেই হয় । ও প্রায় প্রতিমাসেই ঢাকা আসে । ওর আরো কিছু ইনভল্বমেন্ট আছে সেসবেও সময় দেয়, বিভিন্ন সেচ্ছাসেবামূলক আর গঠনমূলক কাজে …

হুম । সমস্যা কোথায়?

সমস্যা …সমস্যা হলো আমি ফিল করছি আমাদের সম্পর্কটা লক্ষ্যহীন, মানে পয়েন্টলেস। অন্তত ওর কাছে। ও আসলে আমার প্রতি ঠিক কমিটেড না। মানে এমনি আমি ক্ষেপে গেলে বা অভিযোগ করলে তখন হয়তো ম্যানেজ করতেই বলল তাঁর আকাশের একলা চাঁদ আমি, একজনই ভালোবাসার মানুষ.। .খোঁজ নেয় আমার অন্য কেউ কিছু আছে কিনা বা কারো সখ্যতা দেখলে…। কিন্তু সেটা আমি সাথে থাকলেই । চোখের আড়ালে গেলে মনেই থাকেনা। আর ও ঠিক আমাকে সেভাবে কখনো প্রপোজই করেনি বা বিয়ের কথাও সরাসরি বলেনি। এখানে একটা কিন্তু হতে পারে আমি পজিশনে ওর চেয়ে সিনিয়র এবং বেশী সচ্ছল। কিন্তু আমাদের সামাজিক কাঠামোতে পুরুষই তো বলবে!
আমি তাও অনেক রকম হিন্টস দেই, তখন বরং সে কেমন উদাস থাকে। হিন্টস যেন ধরতে চায়না। আমাদের ঘনিষ্ঠতাও অফিসে কেউ যেন টের না পায় সেই ব্যাপারে খুব সতর্ক। আবার কারো প্রতি সখ্য দেখলেই জ্বলে ওঠে । এতে অবশ্য আমার ভালোই লাগে। মানে কোনোদিন জীবনে এমন কেউ ছিলনা, তাই পজেসিভনেস টের পাইনি।

অন্য কারো সাথে ওর সখ্য ?

সেটাই , ও তো সব ব্যাপারেই চাপা ঢাক ঢাক গুর গুর , কিন্তু আমি ধারণা করি ওর কারো একজনের সাথে কিছু সখ্যতা আছে। সুন্দরী , সিঙ্গেল, অল্পবয়সী একজনকে লক্ষ্য করছি । আবার … একাধিকও হতে পারে, যাদের আমি চিনিই না। আমি ফলো করেছি ও আমার ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট লাইক দেয়ই না । বলে কিনা গোপনীয়তার স্বার্থে। কিন্তু যাকে সন্দেহ করছি তাঁর পোস্টে, প্রোফাইল ছবিতে প্রায়শই তাঁর কমেন্ট লাইক থাকে। সম্প্রতি খেয়াল করলাম মাসখানেক আগে একটা মেয়ের বৃষ্টিভেজা হাতের জানালা দিয়ে বেড়িয়ে ফুল তুলছে এমন ছবি শেয়ার করেছিল। একজনের কমেন্টে জবাবও দিল ওরই তোলা। ছুটির দিন। জিগেস করলাম , বলল এমনি পেয়েছে। কদিন পর সেই মেয়ের প্রোফাইল ঘুরে দেখি সেই ছবিটার পুরোটা! আমি অনেক এনালাইসিস করলাম। আগেও কেউ কেউ বলেছে, এমনকি আমিও একদিন সেই মেয়ের সাথে দেখেছি । আর ওর আগেও একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। –

আপনার কাছ থেকে সে কি টাকা বা কোনো সুবিধা পায় ।।?

প্রফেশনাল সুবিধা না, তবে টাকা মাঝে মাঝে বিপদে পড়লে দিয়েছি, গিফট মাঝে মাঝেই দেই , খুব খুশী হয় ।

ঝুমুর আমি বুঝতে পারছিনা এত জলের মত কেইস নিয়ে কি ডিসকাস করতে আসছেন? আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন কেন এই ছেলে আপনার সাথে আছে, কেন আদতে এই সম্পর্ক কোনো সিরিয়াস সম্পর্কে মোড় নেবে না। এবং এমন অবস্থায় স্বাভাবিক আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। তো আপনি কি চাইছেন কি উপায়ে এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবেন, এবং কষ্টও পাবেন না এমন কিছু অব্যর্থ টিপস দেব?

না নাহ, এমন টিপস ত ইউ টিউবে ম্যালা ঘুরছে।

তোহ ? দেখুন পুরোনো প্রেম ভুলতে মানুষ যখন নতুন প্রেম শুরু করে তখন তাড়াহুড়ো করে আরো বড় ভুল করে। ভুলের সিরিজ চলতে থাকে। আর আপনি এত বছরে এসে একটা প্রেম করেছেন, ধরেই নিচ্ছি আপনি প্রেমে পরেন খুব কম। কাজেই এও আপনার পক্ষে সুলভ না ।

আমি চাই এমন টিপস দেবেন যেন সে এই তাঁকে যে আমি এত স্পেশাল , এত অমুল্য হিসেবে ট্রিট করেছি এবং তাঁর যে অপব্যবহার সে করেছে তাঁর শিক্ষা দিতে।
থেরাপিস্ট হো হো করে হেসে উঠলেন,

এই ধরনের ছেলেমানুষী , টিপিকাল মেয়েলি লাইন আপনি কিভাবে বলেন ? তাও থেরাপিস্টের কাছে এসে? আপনিও সেই একই ভুল করলেন ঝুমুর যা বেশীর ভাগই করে ! বিশেষত এমন রাগ বা তুমুল অভিমানী মুহূর্তে। ভুলে যান কেন আপনি পয়সা দিয়ে সময় নিয়ে একজন প্রফেশনাল ডাক্তারের কাছে এসেছেন। হিট ম্যান না । আবার বন্ধু আত্মীয় কেউ না যাকে আপনি আপনার পাতে ঝোল টেনে যা বলবেন সে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাবে । বলবে আপনি যা ভেবেছেন একদম ঠিক , এই ছেলে অতিশয় বদ , আপনার অবশ্যই উচিৎ তাঁকে এইভাবে ঐভাবে উচিৎ শিক্ষা দেয়া ।
ঝুমুর অপ্রস্তুত । বিব্রত। ডাক্তার খুবই ঠিক কথা বলেছেন।

শুনুন ঝুমুর, থেরাপিস্টের কাজ হলো আপনি কেন এই সম্পর্কে আছেন , এতে আপনার ভুল কি ছিল কি করে শুধরানো যায় তা বের করা। ভবিষ্যৎ ভুল এড়ানো ।

আমার ভুল? আমার কি ভুল ছিল?

আপনার ভুল প্রেমে অন্ধ হয়ে নিজেকে সুলভ করে দেয়া।

না না আপনি যা ভাবছেন তা না। আমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক কিছু হয়নি।

গুড , বাট সারপ্রাইজিং! এই বয়সেও এমন কোনো ডিমান্ড আপনাদের নাই! ধরে নিলাম এতো টা এগোয় নি বা আপনি , আপনারা রক্ষনশীল। কিন্তু আপনি তাঁর পছন্দ মেনে গিফট করেন , খোঁজ করেন তো নিজের ভালো লাগা থেকেই। সে ত কমিট করেই নি কিছু। আপনি হেলতে গিয়ে চায়ে অতি ডুবানো বিস্কুটের মতো কাপের তলে পড়ে গেছেন । সে কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়া সব পেয়ে গেলে এই রাস্তা কেন বন্ধ করবে? কেন অন্য মেয়ের কথা কেন লুকাবে না? আমি তাঁর কোনো দোষ ত পাচ্ছিনা ।
ঝুমুর স্থানুর মতো শুনতে থাকে।
থেরাপিস্ট নতুন কিছুই বলছেনা। কিন্তু এসব শুনতে সে এখানে আসেনি। খুব রাগ লাগছে উচিৎ উপদেশ না পেয়ে।
পয়সা সময় দুইটাই নষ্ট।

দেখুন ঝুমুর, একটা কথা বলি। আপনি কিছু লুকোচ্ছেন। ডাক্তার এবং উকিলের কাছে কিছু লুকাতে যাওয়ার চেয়ে অর্থহীন কিছুই নাই। যেমন এই মুহূর্তে আপনি কি করেছেন কেন করেছেন, এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার কোনটা আপনাকে চিন্তিত বা ক্ষিপ্ত করছে জানতে হবে। নিজেকে দোষ দেবেন না। আপনার চেয়ে ভালো আপনাকে কেউ বাসবেনা। দিনশেষে আমরা সবাই একা। আর প্রেমে পড়া কখনোই কারো হাতে থাকেনা, কিন্তু প্রেম করাটা কিন্তু মানুষের হাতে । এবং একটা চয়েস মাত্র। এবং সেই প্রেম আজীবন ধরে রাখা সবচেয়ে শক্ত কাজ।
কাজেই এত দুরূহ কাজ ভুল মানুষের জন্য করাটা অপরাধের পর্যায়ে, যার শাস্তি মানুষকে পেতেই হয়। এখন চয়েস আপনার হাতে । এবং তা মেনে নিয়ে একে ছেড়ে দিলেই ম্যুভির মত নতুন প্রেম আপনার সামনে লাফিয়ে পড়বে, তা না। এই চ্যাম্বার থেকে বেড়িয়েই সুচিত্রা সেনের মত আপনি আপনার উত্তম কুমারের সাথে ধাক্কা খাবেন না।
কিন্তু সময় পাড় হয়েই যাবে। যে কোনভাবেই হোক পাড় হবেই। একটা সময় পেছনে ফিরে ভাববেন কি চরম ছেলেমানুষী ভাবনা নিয়ে এখানে এসেছিলেন। ভাববেন এই মানুষকে কিভাবে ভালোবেসেছিলেন। কি করে নিজেকে ছোট করতে পেরেছিলেন। এখনো যদি বের হতে পারেন তো ” ভাগ্যিস পেরেছিলাম” ভাবতে পারবেন। আর তা না করে আজ জোর করলে হয়তো এই ছেলে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় আপানার মত ক্ষমাশীল মহান প্রেমিকাকে বিয়ে করবে। কিন্তু স্রেফ রিলেশনশীপ স্ট্যাটাসটাই পাবেন । আর কিছুইনা।
ঝুমুর উঠে পড়লো।

বসুন। আমার কথা শেষ হয়নি । আমি অযথা এক সিটিং এর জায়গায় দুই সিটিং দিয়ে ভিজিট কামাই না। আপনার চোখ মুখ বলছে রাতে ঘুম হয়নি, সারা দিন অফিসে অসহ্য দিন কাটিয়েছেন। বসুন। লম্বা দম নিন।
ঝুমুর আবারো বসলো।

– এমন কিছু এই ছেলের কাছে আছে যাতে আপনাকে সে ফাসাতে পারে? আগে জিডি করতে হবে সেক্ষেত্রে।

ঝুমুর অস্ফুট কন্ঠে জবাব দিল,

– নাহ তেমন কিছু নেই। কিছু ফটো, সেগুলিও তেমন কিছুনা।

– শিওর ? আবারো বলছি ঝুমুর, এমন কিছু হলে আগে জিডি করে রাখুন।

– নাহ, ও এত নীচে নামবে না এই আস্থা আছে।

– ওহ, তাহলে ভালো। তো জোর করে এখন ধরে ধরে ফোন, ফেসবুক সব কিছু থেকে এই ছেলেকে বাদ দেবেন না। তাতে সে ছুটে এসে নাটক করবে। ফের গলে যাবেন। আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিন। সে যেভাবে অলক্ষ্যে সব করেছে, তাই করুন। আর প্রথমে অবশ্যই যেটা করবেন, ছুটিছাটা অনেক জমা আছেনা? সংসার করেন না যেহেতু
ঝুমুর ধীরে মাথা নাড়লো।

আর্জেন্ট ছুটির আবেদন করে বেড়িয়ে যান। বাইরে । নেটওয়ার্কে বাইরে হলে সবচেয়ে ভালো।

– আরে না নাহ, এমন হুট করে।।

– আজ আপনি মারা গেলে কি হতো অফিসের ? বাসার? দ্রুত বেড়িয়ে পড়েন।
ঝুমুর স্বগতোক্তির মত বির বির করলো

– একা কার সাথে কই আর যাব?

– কোনো বন্ধু বান্ধব ভাই বোন নাই ? ভ্যাগাবন্ড বাউন্ডুলে ঘুড়ে বেড়ানো টাইপ ? বাঁ মফসবলে কোনো আত্মীয়ের বাসা?

– আছে… কিছু ট্যুর গ্রুপও ।।আমার ওদের সাথে হবে না…আমি ম্যাড়ম্যাড়া টাইপ।

ইউ জাস্ট নিড আ ব্রেক ! চার দেয়ালের ভেতর আপনি তমাল থেকে বের হতেই পারবেন না। গ্রাস করবে সারাদিন ফেসবুক সবখানে ওকে খোঁজা, ওর শেষ লগইন খোঁজা, পোস্ট কমেন্ট দেখা — ছুটি নিয়ে বাসায় শুয়ে এই করবেন আপনি।

কথা সত্য ! সে তাই করবে। শুয়ে শুয়ে রোমান্টিক স্যাড ম্যুভি দেখে কেঁদে বুক ভাসাবে আর জাঙ্ক ফুড খেয়ে কয়েক কেজি ওজন বাড়াবে। তাতে করে ডিপ্রেশন আরো বাড়বে।
ঝুমুর বেড়িয়ে পড়লো।
আগামী কালই তমালের অফিসে আসার কথা। ও জানে আজ তমাল ঢাকাতেই আছে। সেই বিশেষ কারো বা কাদেরও সাথেই আছে। তার ভেতরে কেমন একটা জানান কাল রাতে থেকেই দিচ্ছে। ও এসব টের পায় খুব। সেই অসহ্য অবস্থাতেই রাত জাগা, ছুটে আসা।
বৃষ্টি পড়ছে।
ইচ্ছা করেই গাড়ি আনেনি। পুরোনো ড্রাইভারকে জায়গা দেখিয়ে ফিশফাঁশের বিনোদন না দিতে । তুমুল বৃষ্টিতে পর্দা টেনে রিক্সায় বসলো । ঝুম বৃষ্টির সাথে তাঁর ব্রেইন ফ্রীকোয়েন্সি তে অনুরনন তৈরী হচ্ছে। গা কাপিয়ে কান্না আসছে। সে অনেকদিনই কেঁদেছে এই একমুখী সম্পর্কে। আজ শেষবার কাঁদবে ।

তমাল মায়ের অতি আদরের ছোট বোনের ছেলে।
ঝুমুরকে বিয়ে করানোর মায়ের এই নিয়ে ৫ম বারের চেষ্টা । এবং ঝুমুরেরও মায়ের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার পঞ্চমতম অব্যর্থ চেষ্টা। তফাত হলো এবার সে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল…। ভাগ্যিস তমাল পড়েনি! না হলে এবার আর বিয়ের পিড়ি থেকে বাঁচতে পারত না।
ট্যুর গ্রুপে সে নিয়মিত সদস্য।। থেরাপিস্টের কাছে এই ইমেজ ধরা যেত না। তিনি ঝুমুরকে আলুথালু ননএডভাঞ্চারাস মাঝ বয়সীই ভেবে নিক, যে কারোই নজরে পড়বে না।
আজ বাসায় গিয়ে মাকে ধরেও কাঁদবে।
আর্থ্রারাইটিজের ব্যাথায় মা রান্না করতে পারেন না। বুয়ার রান্নাও খেতে কষ্ট হয়। কষ্ট করে কিছু রান্না করে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেন। আজ সে ভালোমন্দ রেধে খাওয়াবে।
কতদিন ম্যুভি দেখেনা, থিয়েটারে যায়না, বিশ্ব সাহিত্যের বই আনতে। বন্ধুগুলি প্রায়ই কত ডাকাডাকি করে ! তমাল তমাল করে বহুদিন কোথাও যায়না । তমালও প্রায়শই তার সাথে কোথাও যায়না। নিজেকে নিজে কত তুচ্ছ, কত ছোট করে ফেলেছে। গভীর প্রেম তাই ই করে।
বাসার দরজা খুলতেই গান ভেসে এলো, পশ্চিমবঙ্গের ম্যুভি, “সোয়েটার” এর গান, ইমন গাইছে,
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,.
শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,.
ব্যাগের ভেতর মোবাইল ভাইব্রেশন মোডে বাজছে।
তমাল।
সুইচ অফ করে ব্যাগে ভরে চেইন টেনে দিল। অনেক বড় যুদ্ধ গেলো তার।
এখন ম্যালা কাজ, আবার ছুটিতে যাবে।
এত কম প্রায়োরিটির কারো ফোন ধরার সময় নাই। যেমন এতদিন তমালের ছিল না।