পলাশ মজুমদার
লেখক কৃষ্ণকমল মজুমদার আর নেই। প্রতিটি টিভি চ্যানেলের স্ক্রলে এ খবরটি ভেসে আসছে। বিভিন্ন শিরোনামে। বারবার। মুহূর্তে মনে পড়ে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষ দেখার স্মৃতি; মানসপটে ভেসে ওঠে তাঁর হাস্যোজ্জল চেহারা।
সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পত্রিকা ও ফেসবুকে ঢুঁ মারি— কাল রাতে ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন স্বনামধন্য এই বাঙালি লেখক। ফেসবুকজুড়ে বয়ে যাচ্ছে শোক ও প্রশংসার বন্যা। গুণী মানুষ মারা না গেলে পোড়া দেশে কখনও মানুষটির কপালে প্রশস্তি জোটে না। যারা তাঁর সম্পর্কে আগে কিছু জানত না, তারাও স্ট্যাটাস দিচ্ছে।
একটা যন্ত্রণাবোধ আমার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। কেন? মজুমদার পদবী দেখে আপনাদের ভাবার কোনো কারণ নেই যে, তিনি আমার আত্মীয়স্বজন কেউ। বলে রাখা ভালো, অনেক কাল্পনিক জিনিসের মতো আমি সামাজিক সম্পর্কের আত্মীয়তায় বিশ্বাস করি না; আত্মীয়তা এক ধরনের সংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। আমার বেশিরভাগ সময় কাটে অনাত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে; অথচ অনেক রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে নেই কোনো প্রকার যোগাযোগ।
আমি মনে করি, পৃথিবীর সব ভাষার লেখক পরস্পরের পরমাত্মীয়; ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিশ কিংবা আফ্রিকার ফরাসি-ভাষী লেখক এবং ভারতের তামিল কিংবা ইরানের ফারসি-ভাষী লেখক একই রক্তকণিকার ধারক। এই বংশধারা প্রবহমান থাকবে যতদিন মানুষ থাকবে, শিল্প-সাহিত্য থাকবে। সেই সূত্রে আমি কৃষ্ণকমলের উত্তরাধিকারী; তিনি আমার পিতা কিংবা পিতামহের মতো পূজনীয়; হয়ত এজন্য স্বজন-হারানোর বেদনা আমার অন্তরে বেহালার করুণ সুরের মতো বেজে চলেছে; নিজেকে সংযত রাখতে পারছি না কিছুতে।
তাঁর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল। কলকাতা বইমেলায়। তা-ও তিন বছর হয়ে গেল। তখন তাঁর বয়স প্রায় আশি বছর। আমি তাঁর একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম; সাক্ষাতকারটি পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। আমাদের পত্রিকায়। ওই সময় আমি চাকরি করতাম ঢাকার একটি মাঝারি মানের দৈনিক পত্রিকায়; সাহিত্যপাতার সহকারী সম্পাদক হিসেবে; পাশাপাশি চলত লেখালেখি।
লেখক হিসেবে কিছুটা নামও ছড়িয়েছিল; লিখেও মোটামুটি আয় করছিলাম। স্ত্রীও হঠাৎ পেয়ে গেল সরকারি চাকরি। এর মধ্যে বসের সঙ্গে চরম আকার ধারণ করল মনোমালিন্য। দূর ছাই যা হবার হবে—এ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আর কারো অধীনে চাকরি করব না; সিরিয়াসলি মনোনিবেশ করব লেখায়।
ছোটবেলা থেকে লেখক হওয়া ছিল আমার স্বপ্ন। লেখক ছাড়া আমি আর কিছু হতে চাইনি কখনো। ভাবতাম মার্কেজ কিংবা মোপাসাঁর মতো পৃথিবীর মানুষ একদিন জেনে যাবে আমার নাম; আমার সন্তানকে পড়তে হবে না অপরিচয়ের অনিশ্চয়তায়; সুযোগটা নেয়াই যাক। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিব বলে ধূম করে চাকরিটা ছেড়ে দিই। বছর খানেক আগে। আমার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি আমার শুভাকাঙ্খীরা; কিন্তু নিজের সঙ্গে আর কিছুতেই পেরে উঠছিলাম না তখন।
কয়েকদিন ধরে ভাবছি দেশভাগের প্রেক্ষাপটে একটি গল্প লিখব; কিন্তু প্লট খুঁজে পাচ্ছি না। কৃষ্ণকমল মজুমদারের মৃত্যুসংবাদ দেখে সেই সাক্ষাতকারের কথা মনে পড়ে যায়; যেখানে পেয়ে যাই গল্পটির বীজ। পরের দিন সন্ধ্যায় পাঠক সমাবেশে বসে আমাদের লেখক-বন্ধুদের সাপ্তাহিক নিয়মিত সাহিত্য-আড্ডা; সেখানে গল্পকার বন্ধু অনিমেষ ব্যানার্জির সঙ্গে গল্পটির ধারণা শেয়ার করি। সে আমাকে উৎসাহিত করে; বলল, লেখো, বেশ জমে উঠবে।
২.
কৃষ্ণকমল মজুমদারের নাম আপনারা যাঁরা সিরিয়াস পাঠক, তাঁরা অবশ্যই শুনে থাকবেন; তিনি সারা জীবন লিখেছেন কেবল একটি বই; অথবা লিখে থাকলেও তা প্রকাশ করেননি বা করতে চাননি। বিচ্ছিন্নভাবে দেশভাগের ওপর কিছু গল্পও লিখেছেন তিনি; কিন্তু পুস্তকাকারে তা লিপিবদ্ধ করে যাননি; পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন কেবল। আমি মনে করি, তাঁর লেখনী থেমে যাওয়াটা বাংলাসাহিত্যের পাঠকদের দুর্ভাগ্য। এমনও হতে পারে জীবনানন্দের মতো মৃত্যুর পর আবিষ্কার হবে টাংকের ভেতর তাঁর অপ্রকাশিত লেখার বিশাল সম্ভার। আমি এরকম কিছু আশা করি।
‘দেশান্তর’ নামক তাঁর একমাত্র উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট পাকিস্তান আন্দোলন ও দেশভাগ। পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলার গৌরনদীর প্রত্যন্ত এক গ্রাম ছিল উপন্যাসটির পুরো অবয়বজুড়ে। একটি একান্নবর্তী পরিবারের সুখ-দুঃখ ও ঘাত-প্রতিঘাতকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসটির শেষ পর্যায়ে ঘটে পরিবারটির দেশান্তর; ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের ফলশ্রুতিতে। দেশভাগের ওপর এর চেয়ে মর্মন্তুদ কোনো উপন্যাস বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই; কিংবা লেখা হলেও আমি পড়িনি। বিশ্বসাহিত্যে কেবল একটি বইয়ের জন্য কেউ যদি অমর হয়ে থাকেন, তিনি বাংলাসাহিত্যের এই প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক। আমি নিশ্চিত, এমন উপন্যাস ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় লেখা হলে নোবেল পুরস্কার পেতেন লেখক।
আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটির অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে মহব্বত নামক একটি চরিত্র আমার হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। ওই সময় কথা প্রসঙ্গে আমি মহব্বতের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি হেসেছিলেন, উপন্যাসে অনেক কাল্পনিক চরিত্র থাকলেও মহব্বত চরিত্রটি বাস্তব। একথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। এটা কী করে সম্ভব! অথচ আমার ধারণা ছিল, ভিন্নধর্মী চরিত্রটি সম্পূর্ণ লেখকের কল্পনাপ্রসূত।
আমার অনুরোধে তিনি তখন তাঁদের বরিশালের বাড়ির চাকর মহব্বতের ব্যাপারে যা বললেন তা কোনোদিন ভুলতে পারব না। এই মহব্বত আমার আজকের গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। পাঠক, বিশ্বস করুন, লেখকের বয়ানের সঙ্গে আমি সামান্যও রঙ মিশাইনি।
৩.
মহব্বত ছিল আমাদের বাড়ির কাজের লোক; তবে আমরা তাকে কখনো চাকর ভাবিনি, বরং পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে করতাম; ডাকতাম মহব্বতদা। ধরতে গেলে সর্বক্ষণই সে আমাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত; বিশ্বস্ততার ঘাটতি ছিল না কোথাও।
জীবনে অনেক বড় মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু তাঁর মতো এমন স্বশিক্ষিত মানবতাবাদী মানুষ আমি কখনো দেখিনি। অনেকে সাম্যবাদের আদর্শ কপচায়, বুলি আওড়ায়, অথচ সময়মত আসল চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অল্প মানুষ পারে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাসের প্রতিকূল স্রোতে ভাসতে। মহব্বতের মতো সাধারণ এক শ্রমজীবী মানুষ পেরেছিল; কীভাবে সে যাবতীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠেছিল তা আমার কাছে এক বিস্ময়; এজন্য, কেবল এজন্য সে আমার নমস্য।
সে যে একজন দার্শনিক এবং তাঁর যে নিজস্ব একটি জীবনদর্শন ছিল তা বড় হয়ে আমি বুঝতে পেরেছি। মূলত সহজাত প্রবৃত্তি ছিল তাঁর ভেতরকার নিয়ন্তা। সবসময় নিস্পৃহ; আপন মনে পরম যত্নে কাজ করতে ভালোবাসত সে; কোনো মানুষের প্রতি ছিল না তাঁর কোনো অভিযোগ বা বিদ্বেষ।
মহব্বতদার ছিল বিশেষ কিছু গুণ। সে গান করত। বাঁশি বাজাত। বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে যেত চারপাশের মানুষ। কেউ কেউ বলত, তাঁর বাঁশি শুনে চাঁদনী রাতে তরমুজ খেতে পরি নেমে আসে। অপ্সরা নামের এক পরির সঙ্গে না কি তাঁর ভাব; নইলে এত রাতে সে কাকে বাঁশি শোনায়, কার সঙ্গেই বা কথা বলে! কার প্রেমে উতলা হয়ে সারাদিন গান করে সে! বৌয়ের কাছে কি সে যায়? বৌতো পঙ্গু। সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। নাহলে এমন বলিষ্ঠ পুরুষ তাঁর শারীরিক প্রয়োজন মেটায় কার সঙ্গে? নিশ্চয়ই ওই পরির সঙ্গে। এরকম অনেক গুজব ভাসত আকাশে বাতাসে।
সে ছিল জাতশিল্পী; সহজে যেকোনো শিল্পকর্ম আয়ত্বে নিয়ে আসতে পারত; কখনো কখনো দেখে দেখেও। কীর্তনগানেও ছিল তাঁর অসামান্য দক্ষতা। যাত্রাপালায়ও ফুটিয়ে তুলত নিপুণ অভিনয়। কীভাবে যেন নাচও শিখেছিল। দুর্গাপুজোয় আরতিতে সে যে নাচ করত, তা হয়ে ওঠে কিংবদন্তী। তাঁর এই শিল্পবোধ ছিল স্বগোত্রীয় মানুষের গাত্রদাহের কারণ। অনেকে তাঁকে বলত, হিন্দু বাড়িতে থাকতে থাকতে তুই হিন্দু হয়ে গেছিস রে, মহব্বত। এরকম কথা শুনে মনে মনে হাসত সে।
কখনো বলত, হিন্দুরা কি মানুষ নয়? কখনো বলত, সব মানুষ আল্লার সৃষ্টি; আল্লাকে মানলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে; মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করা যাবে না। মানুষের মধ্যেই আল্লা; নিজের হৃদয় খুলে দেখো— মক্কা মদিনা গয়া কাশি বৃন্দাবন সব এখানে। আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে, দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে।
কখনো বলত, আমি তো আসলে কিছু করি না, আমাকে দিয়ে তিনি করান। ওই তিনি যে কে, তা সে কখনো বলত না; তবে লালনের গান করার সময় তাকে বাউল ছাড়া অন্য কিছু মনে হত না; মাঝে মাঝে ধারণ করত বাউলের বেশ। রাসপূর্ণিমার সময় সে কুষ্টিয়ায় চলে যেত কয়েকদিনের জন্য। কথা-প্রসঙ্গে বলত, আমি ফকির মহব্বত, ফকির লালনের শিষ্য। এত দরদ দিয়ে লালন সাঁইজির গান করতে আমি কোনো বাউলকে কখনো দেখিনি।
অনেকে তাঁকে ডাকত বিধর্মী; তাঁর সঙ্গে মিশতে চাইত না গ্রামের মুসলমানদের কেউ। আপন ভাইয়েরাও তাঁর সঙ্গে কথা বলত না। তাঁকে দেখলে কেউ কেউ দূর দূর করে তাড়াত; সে এসব গায়ে মাখত না। এমন আচরণের পরও কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ ছিল না তাঁর। বলত, নিজের মতো করে চলার অধিকার সব মানুষের আছে; মানুষ যেমন মানুষকে ভালোবাসতে পারে, তেমনি ঘৃণাও করতে পারে—এটা মানুষের জন্মগত অধিকার। সে চলত নিজের মতো; তাঁর চলার পথ যেন স্বসৃষ্ট!
মহব্বতদা ছিল নিঃসন্তান। সন্তান জন্ম দিতে না পারার দুঃখে তাঁর স্ত্রী হোসনা সবসময় মনমরা হয়ে পড়ে থাকত। সন্তানের আকাঙ্খায় হোসনা তাঁকে আবার বিয়ের জন্য চাপ দিলে সে বলত, বিয়ে মানুষের জীবনে একবারই হয়; আবার কাউকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা অসম্ভব। সন্তান না হলে না হবে, তবু সে হোসনার মনে কোনো দুঃখ দিতে পারবে না। এমন কথা শুনে হোসনা মনে মনে খুশি হতো।
নিজের প্রতি স্বামীর প্রেম দেখে গর্বে ভরে যেত হোসনার বুক। অথচ হোসনা দেখে, তার দেবর কামাল প্রতি রাতে বৌকে না পিটিয়ে ঘুমাতে যেতে পারে না। স্বামীভাগ্য নিয়ে যে জায়েরা তাকে ঈর্ষা করে তা সে টের পায়। কখনো কানে আসত, খানকির ন্যাকামি দেখে বাঁচি না! সে কোনো প্রতিবাদ করত না। স্বামীর হাসিমাখা মুখখানি দেখলে তার সব কষ্ট উধাও হয়ে যেত মুহূর্তে।
দারিদ্র্য, সন্তানহীনতা, স্ত্রীর বিকলাঙ্গতা কোনো কিছু নিয়ে মহব্বতদার কোনো আফসোস ছিল না। হোসনার হতাশা দেখে সে শুধু বলত, বিবি, সব আল্লার ইচ্ছা। নাখোশ হয়ো না। সবসময় শোকর করো। খোদা বিভিন্নভাবে মানুষের পরীক্ষা নেন। এক জীবনে মানুষ সব পায় না; কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়। আমাদের তো ভাত-কাপড়ের অভাব নেই; অথচ দেখো জামাল ও কামালের ঘরভর্তি ছেলেমেয়ে থাকলেও অভাবের শেষ নেই, না খেয়ে থাকতে হয় বেশিরভাগ সময়; ছেলেমেয়েগুলো যেমন রোগা তেমন চিকন ও হাড়জিরজিরে; প্রতি বছর বাচ্চা জন্ম দিতে দিতে বৌগুলোর অবস্থা কেমন হয়েছে! স্বামীর কথা শুনে হোসনা আর কিছু বলার সাহস পেত না।
মহব্বতদা দিনে তিনবার বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীকে কেবল খাইয়ে আসত; আর সারাদিন পড়ে থাকত আমাদের কাজ নিয়ে। ক্ষেতখামারের কাজ, গরু-ছাগল লালনপালন, বাজার করাসহ সব ধরনের ফরমায়েস খাটা— কোনো কিছুতে তাঁর কোনো ক্লান্তি ছিল না। মানুষটির মধ্যে অলসতা আমি কখনো দেখিনি; আর খেয়াল করতাম সে যেন সবসময় আনন্দের সাগরে ভাসছে; গান ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারত না সে।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে হোসনা মারা গেলে কেউ দাফন করতে আসে না। লোকজন বলে বেড়াতে লাগল, কাফেরের বউয়ের লাশ কেউ যেন স্পর্শ না করে ; মসজিদের ইমামকে সাবধান করে বলল, তিনি যেন জানাজা না পড়ান। সে প্রতিবাদ করে, আমার বয়ে গেছে! মড়ার আর ধর্ম কী!—ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চাড়াল মুচি/ এক জলে সব হয় গো শুচি।—যা হওয়ার শেষ বিচারের দিন হবে। তবু কাউকে দোষারোপ করে না সে। একা একা বাড়ির উঠোনের এক প্রান্তে হোসনার লাশ কবরস্থ করে সে; কবরের ওপর লাগিয়ে দেয় একটি তুলসী গাছ।
জীবিত মানুষের প্রতি অবজ্ঞা মেনে নিলেও মৃতের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ সে মানতে পারে না; প্রচলিত ধর্মকর্ম ও গতানুগতিক সমাজব্যবস্থার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সে; তাঁর ভেতর জেগে ওঠে বিদ্রোহী। সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে সে আমাদের পরিবারের সঙ্গে আরো বেশি জড়িয়ে পড়ে; বন্ধ করে দেয় বাড়িঘরে যাওয়া। প্রতি শুক্রবার রাতের আঁধারে চুপি চুপি স্ত্রীর কবরে ফুল দিয়ে আসত কেবল।
আমার প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব একটু বেশি ছিল। সে চেষ্টা করত আমার সব আবদার মেটানোর। আমার বড়দা ও মেজদা এটা ভালোভাবে নিত না; তারা সবসময় চাইত সে যেন তাদের প্রতি বেশি খেয়াল করে। আর মহব্বতদা সবাইকে খুশি রাখার জন্য ব্যস্ত রাখত নিজেকে।
অন্যান্য হিন্দু পরিবারের মতো আমাদের পরিবারেও ছোঁয়াছুয়ির বাতিক ছিল। দৈবাৎ অন্য জাত বা মুসলমান কেউ আমাদের ছুঁয়ে দিলে স্নান করে পরিশুদ্ধ না হলে খাবার জুটত না। অথচ মহব্বতদার বেলায় আমাদের কোনো শুচিবায়ু ছিল না; কারো কখনো মনে হত না যে, সে হিন্দু নয়। এমনকি আমার গোঁড়া জ্যাঠামশায় পর্যন্ত তাঁর হাতে ধরা জিনিস খেতে কুণ্ঠাবোধ করত না। আমার অসুস্থ ঠাকুরদাকে গায়ে জল ঢেলে সে প্রায়ই স্নান করাতো।
শুনেছি বারো বছর বয়সে পিতৃহারা হয় সে। তখন থেকে সে আমাদের বাড়িতে। আমার জন্মের সময়ও আমাদের বাড়িতে ছিল; সেই ঘটনাটি সে যে আমার কাছে কতবার করেছে তার ইয়ত্তা নেই। সেদিন ঝড়ের তা-বে পৃথিবীতে না কি প্রলয়লীলা ঘটেছিল। এর মধ্যে মাঠ-ঘাট নদী-নালা পেরিয়ে আমার বাবাকে খবর দিতে ছুটেছিল সে। বিশ মাইল পরের এক দূরবর্তী গ্রামে বাবা জমিদারের কাছারিতে নায়েবের চাকরি করত। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে সে; তাঁর জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়; রাতের অন্ধকারে অশরীরীরা না কি তাঁকে তাড়া করেছিল; দিগি¦দিকশূন্য হয়ে ছুটতে ছুটতে সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল; প্রায় দশদিন খবর ছিল না। অনেকে বলেছে, তাঁকে জিনেরা তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল।
১৯৪৬ সালের শেষ পর্যায়ে বরিশালে ঘটে যায় ভয়াবহ দাঙ্গা। দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় আসলে তা নয়, কারণ মুসলমানরা একতরফা হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে; মেতে ওঠে হত্যার হোলিখেলায় ও নারী ধর্ষণে। জীবনবাজি রেখে আমাদের রক্ষা করেছিল বলশালী মহব্বত। চিৎকার দিয়ে বলল, দেখি কার এত বড় সাহস যে এই বাড়িতে আক্রমণ করে! পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব। বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। বদমাশ সব শালারা। ইত্যাদি ইত্যাদি। চোরাগোপ্তা হামলা করে অবশেষে পালায় দাঙ্গাবাজরা।
তখন মারাত্মক জখম হয় তাঁর একটি চোখ; মাথায়ও লাগে আঘাত। আমার বাবা পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মহব্বত, তুমি এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিলে কেন? সে বলেছিল, অমানুষ মানুষ মারতে এলে মানুষকে বাঁচানো যেকোনো মুসলমানের জন্য ফরয; এটা আমার ধর্মের শিক্ষা। তাঁর সাহসিকতা ও নীতিপরায়ণতায় বেশ খুশি হন বাবা।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনদিনও আমরা বরিশালে থাকতে পারিনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর আসতে লাগল। আমরাও বেরিয়ে পড়ি। বাস্তুভিটা হারানো মানুষের ঢল নামে পশ্চিমের দিকে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় আমাদের প্রতিবেশী হরিদাস ও সুধাকাকার পরিবারও। আমরা কৃষ্ণনগরে পিসির বাড়িতে চলে আসি; জলের দরে সহায় সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে; একরকম নিঃস্ব অবস্থায়। এতকালের চিরচেনা পরিবেশ, ঘরবাড়ি রেখে আসতে হলো বলে আমার মা-কাকিমার কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। আমি নিজেও চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। মহব্বতদা তখন আমাদের বিভিন্নভাবে প্রবোধ দিয়ে নিরস্ত করেছিল।
আমার বয়স তখন কত হবে? বড়জোর ১০। আমি পড়তাম ক্লাস ফাইভে।
আমাদের সঙ্গে মহব্বতদাও কৃষ্ণনগরে চলে আসে। বাবা তাঁকে আসতে অনেকবার নিষেধ করেছিল। সে বলল, বাবু, তোমরা না নিয়ে গেলে আমাকে গলা টিপে মেরে যাও; নইলে আত্মহত্যা বা দেশান্তর ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। দুনিয়াতে আমার আর কে আছে! আমি কার কাছে থাকব!
আমার বাবা ছিলেন খুব সংবেদনশীল; শ্রদ্ধা করতেন মানুষের অনুভূতিকে। যদিও তিনি ধর্মকর্ম মানতেন না; তাঁকে মন্দিরে যেতে কেউ কোনোদিন দেখেনি; তবে মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল অগাধ। শুনেছি তিনি যুবা বয়সে কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। ভালোবাসতেন হিন্দু-মুসলমান সবাইকে। দেশভাগ কিংবা দাঙ্গার কারণে গ্রামের মুসলমানদের প্রতি বাবার কোনোপ্রকার ক্ষোভ ছিল না।
অনেক মুসলমান আমাদের জন্য কেঁদেছিল তখন। সেই বিদায়ের দৃশ্যটি আজো আমার মনে ভাসে। আমাদের নৌকা অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা দাঁড়িয়ে চোখ ভাসাচ্ছিল নদীর পাড়ে।
মহব্বতদাকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাঁর ব্যথিত মুখ দেখে বাবা বললেন, ঠিক আছে, চল তাহলে।
বিমর্ষ মহব্বতদার চোখে-মুখে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় মুহূর্তে। গম্ভীর মুখে ভেসে ওঠে আলোকের ঝর্ণাধারা। হঠাৎ সে বলল, শুনেছি নদীয়ায় অনেক বাউল বাস করে। প্রয়োজনে আমি তাঁদের দলে ভিড়ে যাব; বাউলগানে মেতে থাকব; জীবনটাকে সার্থক করব। গুনগুন করে গান গায়— তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে/ তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
কৃষ্ণনগরে এসে সে যেন নিজেকে খুঁজে পায়। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত। এক সপ্তাহ দশদিন পর ফিরে এসে বলত, গান করতে গিয়েছিলাম। কখনো কাটোয়া, কখনো বর্ধমান, কখনো মুর্শিদাবাদ, কখনো মেদিনীপুরে। আর নিয়ে আসত অনেক উপহারসামগ্রী। আমাদের জন্য বিভিন্নরকম খাবার। লম্বা লম্বা চুল রেখে আলখাল্লা পড়া শুরু করেছিল। তাঁর এই নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে কেউ কিছু বলত না। বাবার নিষেধ ছিল। তাছাড়া এখানে তেমন কাজও ছিল না। শেষের দিকে তাঁকে ক্ষয়রোগে ধরেছিল। সেও জানত, আর বেশিদিন আয়ু নেই।
মরার আগে সে বাবাকে বলেছিল, তাঁকে যেন সনাতন মতে দাহ করা হয়। আমার কাকা জ্যাঠা আপত্তি করলেও বাবা বলেছিলেন, তাঁর শেষ ইচ্ছেটা আমাকে রাখতে হবে। সারাটা জীবন তো সে আমাদের জন্য করেছে; দেশ পর্যন্ত ছেড়েছে।
সে যখন মারা যায় তখন আমি সরকারি চাকরিতে মাত্র যোগ দিয়েছি। পড়াশোনা শেষে। চিতা জ্বলার সময় আমার কেবল তাঁর এই কথাগুলো মনে পড়ছিল, বাবু, আমি দেশ বুঝি না, জাত বুঝি না, ধর্ম বুঝি না। আমি কেবল মানুষ বুঝি। আমি তো শুধু মানুষ হতে চেয়েছি। আর মানুষকেই ভালোবেসেছি।
৪.
আজো স্পষ্ট মনে আছে, আমার সঙ্গে সেদিনের সাক্ষাতকারে কৃষ্ণকমল মজুমদারের শেষ কথাটি, আমি তো সারাজীবন মহব্বতদার মতো মানুষ হওয়ার সাধনা করেছি; তা আর হতে পারলাম কই! যদি হতে পারতাম, জীবনটা ধন্য হতো!