কর্মকার অনুপ কুমার

প্রতিদিনের সন্ধ্যাবেলায় নিখিলের চায়ের দোকানের আড্ডার প্রাণ আমরা চার পাঁচ জন। এই মফস্বলে কোন ক্লাব বা আড্ডাখানা নেই বলে আমাদের সন্ধ্যার ডেরা এই নিখিলের এই ছোট্ট চায়ের দোকান। চা সিগেরেটের সাথে আড্ডাটা কোন কোন দিন চলে রাত এগারোটা পর্যন্ত। বলা যায় সারা বছর পাড়াগাঁয়ের এই দোকান আমরাই জমিয়ে রাখি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরিজীবী অথবা ব্যবসায়ী, কেবল আমি ছাড়া। আমি বেকার, কোন রকম পরাধীনতায় আবদ্ধ হতে চাইনি। তাই চাকরিতে ঢোকা হয়নি। প্রতিদিন আমি নিখিলের দোকানে সবার আগে আসি। অন্যরা সারাদিনের কাজ শেষ করে আড্ডা দিতে আসে এবং সেটা চলে রাত অবধি।

মাঘ মাস, চারিদিকে কনকনে ঠান্ডা। সেদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলায় বরাবরের মত আড্ডা বসেছে। চায়ের কাপে ঠোকাঠুকি আর সিগেরেটের ধোঁয়ায় লিখিলের দোকান সরগরম। কিন্তু আড্ডায় মোটামুটি সবাই এলেও শেখর নাগ আর রাজু সাহার দেখা নেই। বলা বাহুল্য যে দু’জনের কথা উল্লেখ করলাম এই দু’জনই দিন কয়েক আগে বিয়ে করেছেন এবং আমাদের আড্ডার বাকীরা সকলেই এখনো অকৃতদার। এ নিয়ে কথা উঠলে নিশিকান্ত রায় বলে উঠলো

—     কী হে! শেখর আর রাজুর কোন খবর নেই যে?

আমাদের মধ্যে মদন মিত্র একটু মুখভাঙ্গা ধরণের। মানে যত লজ্জার কথাই হোক এক নিমেষে সেটা বলে ফেলে হা হা হি হি করে হেসে উঠবে। নিশিকান্তর প্রশ্নের জবাবে মদন উত্তর করলো

—     দেখো গিয়ে, শীতের সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই বউয়ের আঁচল তলে উষ্ণতা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

মদন কথাটা বলতেই আমাদের আড্ডায় বিদ্যুতের মত একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। অবিবাহিত বন্ধুরা সদ্য-বিবাহিত বন্ধুর পেছনে তার বৈবাহিক স¤পর্কের কথা খুব মুখরোচক করে কপচাতে ভালোবাসে। এটা আমাদের বাঙালিদের বন্ধু মহলে একটা অলিখিত সংবিধানের মত পালন করা হয় বলা যেতে পারে। মদনের কথা শুনে আমারও হাসি এসেছিলো বটে তবে সেটা প্রকাশ করতে কিছুটা লজ্জাবোধ করছিলাম। সবার হাসি থামতে না থামতেই নিশিকান্ত দাতমুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো

—     এই জন্যই শালার বিয়ে করি না। স্বাধীন ভাবে আড্ডা দিতে পারবো না, বন্ধুদের সময় দিতে পারবো না। কথায় কথায় জবাবদিহিতা করতে হবে। এটা কোন জীবন!

নিশিকান্তর কথায় মদন উত্তর করলো

—     বিয়ে করতে চাওনা ভালো কথা। কিন্তু বিয়ের পড়ে মানুষ কী করে প্রতি রাতে মধু আস্বাদন করে সে কথায় তো তোমার আগ্রহের কোন কমতি দেখি না।

মদনের এমন কথায় এবার আমি না হেসে পারলাম না। শুধু হাসলাম কথাটা বললে ভুল হবে। মদন যখন কথাটা বলা শেষ করলো তখন আমার মুখে চায়ের চুমুক। মদনের কথায় মুখ থেকে চা গলার মধ্য থেকে তালুতে গিয়ে ঠেকেছে একেবারে। শেষে কতক্ষণ কাশি আর হাসির মিশ্রণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হলো।

আমাদের আড্ডা চলছিলো। রাত আটটা নাগাদ শেখর আর রাজুর দেখা পাওয়া গেলো। শেখর আর রাজু নিখিলের দোকানে ঢুকছে এমন সময় মদন সিগেরেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভরাট কণ্ঠে অনেকটা খেলার ধারাভাষ্যের মত সুর দিয়ে বলতে থাকলো

—     এইমাত্র আমাদের আড্ডা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন সুখি স্ত্রীদের নয়নের মণি, স্থির গৃহে ভূক¤পনের কারণ, স্বর্ণপদক প্রাপ্ত আসল পুরুষ শ্রী শেখর নাগ এবং শ্রী রাজু সাহা। আপনারা তাদের করতালির মাধ্যমে বরণ করে নিন।

আমি মদনের হাত টিপে বললাম

—     আহ্ মদন, করছো কী? ওরা কী ভাববে বলতো।

শেখর মদনের হাত থেকে সিগেরেটটা নিতে নিতে বলল

—     বিয়ে কর শালা, বুঝবি তখন কোন গোলায় কত ধান থাকে।

আমি বললাম

—     তোমরা যাই বলো ভাই। এই বিয়ে ব্যাপারটা না আমার কাছে একটা শেকল বাঁধা ছল মনে হয়। দেখো না। এই যে তোমরা সন্ধ্যার আড্ডায় সময় মত আসতে চাইলেই আসতে পারো না।

নিশিকান্ত আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল

—     অর্ঘ্য, তোমার কথায় তাহলে যেটা দাঁড়ালো যে পুরুষের বিয়ে করা উচিৎ নয়?

আমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে মদন বলল

—     নিশি আর অর্ঘ্য, দু’জনেই শোনো। একজন পুরুষের জীবনে বিয়ে কেন করতে হয় জানো?

বিয়ে করতে হয় তার কারণ একজন পুরুষকে আমাদের এই আবহমান সমাজে বংশ পর¤পরা রেখে যেতে হয়।

আমি বললাম

—     তার মানে কী দাঁড়ালো? শুধু বংশ রক্ষার জন্য মানুষ বিয়ে করে? আর কোন কারণ নেই?

মদন এবার স্বাভাব সুলভ হাসি হেসে বলল

—     আর যেটা কারণ তার জন্য তো বিয়ে ছাড়া আরও বহু ব্যবস্থা আছে চাঁদু।

আড্ডায় আবার হাসির রোল পড়ে গেলো। শেখর কিছুটা ঠান্ডা গলায় বলল

—     আসলে তোমরা বিয়ে করোনি তো তাই তোমাদের কাছে বিষয়গুলো এমন মনে হচ্ছে। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে জীবনে বাঁচার জন্য দু’জন মানুষের মানসিক ভাবে কাছে থাকাটা জরুরী। এই যে আমরা কাজ করি, আড্ডা দেই, হুল্লোড় করি, কিন্তু দিন শেষে কিন্তু আমরা একটা মানসিক আশ্রয় খুঁজি। এই আশ্রয়টার জন্যই মানুষ বিয়ে করে।

এতক্ষণ আমাদের এই আলোচনায় একটাও কথা বলেনি রাজু। ও আজ চুপচাপ সবার কথা শুনছে আর চায়ের কাপে মনোযোগ দিচ্ছে। নিশিকান্ত বিষয়টা খেয়াল করে রাজুর ব্যাপারে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল

—     কী ব্যাপার অর্ঘ্য? আমাদের রাজু বাবুর মুখে কোন কথা নেই আজ খেয়াল করেছো? ঘটনাটা কী?

আমি কিছু বলার আগেই রাজু উত্তর করলো

—     নাহ্, মনটা আজ বিশেষ ভালো নেই গো নিশি। নিজে বলার থেকে তোমরা গল্প করছো সেটাই শুনছি মন দিয়ে।

রাজু যেহেতু সদ্য বিবাহিত এবং মদনের কথা বলার যে বৈশিষ্ট্য তাতে এ সুযোগ মদনও ছাড়লো না। খুব মাখো মাখো কণ্ঠে মদন বলল

—     কেন রাজু বাবু, বৌঠান তোমাকে খাটে উঠতে দেয়নি বুঝি?

মদনের কথা শোনার পর সবার অট্টহাসিতে নিখিলের দোকান ফেটে পড়ার অবস্থা। নিশিকান্ত বলল

—     মদন, রাজুর যেহেতু মন খারাপ। তাহলে আজ হয়ে যাক একটা কিছু! কী বলো তোমারা সবাই?

আমি বললাম

—     তোমাদের একটা কিছু বলতে তো এক বোতল দেশি আর পাঁঠার কষা মাংশ। তা সেটা রাজু অবিবাহিত থাকতে তো ওর বাড়িই ছিলো আমাদের এমন হুটহাট আয়োজনের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। কিন্তু এখন তো বাড়িতে বৌঠান আছেন। এখন কী আর সে স্থানে এমন আয়োজন শোভনীয়?

আমার কথায় সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে মদন বলল

—     একটা উপায় আছে। তবে সেটায় তোমাদের সাহসের পরীক্ষা দিতে হবে।

শেখর বলল

—     দেখো মদন, এমন আয়োজন তো আমরা নতুন করছি না। এতে সাহসের কথা আসছে কেন?

মদন কিছুটা উৎসাহিত কণ্ঠে বলল

—     সাহসের কিছু তো আবশ্যই আছে! কারণ আমি যেটা ভেবেছি সেটা যদি করতে পারি তবে জায়গাটা যেমন নিরাপদ হবে তেমনি আনন্দটাও নির্ঝঞ্ঝাট হবে। সে সাথে একটা ইতিহাসও আমরা রচনা করে ফেলবো।

মদনের কথার দীর্ঘসূত্রিতা দেখে সকলে কিছুটা বিরক্ত হয়ে একসাথে বলে উঠলো “সেটা কী?”। মদন এবার তার পরিকল্পনা বলতে আরম্ভ করলো

—     আমরা আমাদের আয়োজনটা পোড়া নটীবাড়িতে করতে পারি।

পোড়া নটীবাড়ির কথা শুনে সকলের চোখ ছানাবড়া। এখানে পোড়া নটীবাড়ির কিছু ইতিহাস বলে নেয়া ভালো। পোড়া নটীবাড়ি হচ্ছে আমাদের এলাকার একটা প্রাচীন পোড়োবাড়ি। একসময় এখানে বারবনিতাদের আখড়া ছিলো। বৃটিশরা দেশ ছেড়ে যাবার পর দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগে। তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের আক্রমণের শিকার হয় এই বারবনিতাদের আখড়া। বাড়ির ভেতরে যারা ছিলো তারা কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলেও দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে রেহাই পায়নি কেউ। সবাইকে ধরে বাড়ির মধ্যে আটকে দিয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ফলে এখানকার সকল বারবনিতারা জীবিত অবস্থায় পুড়ে মারা যায়। এই ঘটনার পর ঐ বাড়ির আশপাশে রাত বিরাতে অনেকেই মেয়ে ছায়ামূর্তি হাঁটতে দেখেছে। আবার কেউ কেউ ওখান থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনেছে। লোকমুখে শোনা যায় যার নেতৃত্বে দাঙ্গাবাজেরা এই বাড়ি আক্রমণ করেছিলো তার স¤পূর্ণ নগ্ন মৃতদেহ এই বাড়ি পুড়িয়ে দেবার তেরো দিনের মাথায় বাড়ির ভেতরেই পাওয়া যায়। এরপর থেকে মানুষ ঐ বাড়ির আশপাশ থেকে চলাচল বন্ধ করে দেয়। এর পরেও কেউ কেউ সাহস দেখিয়ে ঐ বাড়িতে যাবার চেষ্টা করেছিলো। তবে যারা সাহস দেখিয়ে ঐ বাড়ির ভেতরে গিয়েছে তাদেরই নাকি নগ্ন অবস্থায় মৃত পাওয়া গেছে। একাত্তরের যুদ্ধের সময় কয়েকজন রাজাকার এই বাড়িটাকে দখল করে জমি হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু যারা ঐসব রাজাকারদেরকে যুদ্ধের পর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের পরিবারের লোকজন ঐ বাড়ি থেকে তাদের ব্যবহৃত পোশাক আর কিছু অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায়নি। তারপর থেকে অদ্যাবধি আমাদের এলাকার কোন মানুষ ঐ বাড়ির দিকে যায় না। মানুষের যাতায়াত না থাকায় বাড়িটা জঙ্গলে পরিপূর্ণ এক ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।

আমাদের কথোপকথনে পোড়া নটীবাড়ির কথা শুনে লিখিলে চোখমুখে বাজপড়া তালগাছের ছায়া দেখা গেলো। নিখিল আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল

—     দাদা আপনারা ভুলেও এই কাজটা করবেন না। আপনারা সবাই এই এলাকাতেই বড় হয়েছেন। পোড়া নটীবাড়ির কথা কমবেশি সবাই জানেন। আনন্দ করতে গিয়ে একটা বিপদ আপদ না হয়ে যায়।

নিখিলের কথায় মদন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল

—     ধ্যাৎ ব্যাটা! কোন মান্ধাতার আমলের কোন ভূতের গপ্পো শুনে একটা ভয়ের নাটক সাজাচ্ছিস। ভূত বলে কী কিছু আছে নাকি?

সত্যি বলতে ভূত বা প্রেততত্ত্ব বিষয়ে আমার আগ্রহ অনেক কিন্তু গভীর বিশ্বাস বা ভয় ছিলো না কখনো। তবুও মদনের অদম্য আগ্রহ দেখে বললাম

—     সবই ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু যেখানটাতে এতদিন লোকজনের যাতায়াত নেই সেখানে তাও আবার এই রাতবিরাতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে। দেখাগেলো ভূত নেই কিন্তু সাপ বা কোন জন্তু জানোয়ার তো থাকতে পারে।

আমার কথায় শেখর আর রাজু সায় দিলো। কিন্তু নিশিকান্ত বলল

—     তা মদন যখন বলছে তখন একটাবার চেষ্টা করেই দেখা যাক না। তারপর ওখানে গিয়ে যদি দেখি একেবারেই অনুপযোগী পরিবেশ তখন না হয় আশেপাশের যেকোনো একটা জঙ্গলে বসে আয়োজনটা করা যাবে।

নিশিকান্তর কথাটা আমার মনে ধরলো। রাজুর মন খারাপ তাই রাজুর এখানে কোন মন্তব্য পাওয়া গেলো না। বাঁধ সাধলো শেখরকে নিয়ে। শেখর বলল

—     যাই বলো ভাই, এখানে যাওয়াটা আমাদের ঠিক হবে না। তোমরা অন্য চিন্তা করো।

শেষে সবার প্ররোচনায় শেখরও আমাদের সাথে না গিয়ে আর পারলো না। শেখর আর রাজুর বাড়িতে নিখিলকে দিয়ে খবর পাঠানো হয়েছে যে ওরা রাতে নাও ফিরতে পারে বা ফিরলেও দেরি হবে।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা সরঞ্জামাদি নিয়ে পোড়া নটীবাড়ির সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত ধরণের বাড়ি আমাদের চোখে পড়লো। পুরনো ও পরিত্যাক্ত বাড়ি অনেক দেখেছি কিন্তু এমন গা ছমছমে শীতলতা সেসব বাড়িতে ছিলো না। বাড়ির সদর দরজার ভেতরেই অনেক গাছপালা হয়ে গেছে। তাই ঢোকার মুখে আমাদের কিছুটা বেগ পেতে হলো। বাড়িতে সম্মুখ দরজায় একখানি কপাট নেই, আর যেটি আছে সেটিও পোড়া কয়লার মত দাঁড়িয়ে যেন বাড়িতে আগতদের শীতল স্বাগতম জানাচ্ছে। বাড়ির নীচতলাতে আমরা যখন ঢুকলাম তখন কতগুলো বাদুড় আর চামচিকা শব্দ করে বেরিয়ে গেলো। আমাদের প্রত্যেকের হাতেই টর্চ। তাই আলো স্বল্পতা নেই। শেখর একটু ভীতু প্রকৃতির। বাড়ির এই গা ছমছমে ভাবটা প্রথম থেকেই ওর সহ্য হচ্ছিলো না। তাই আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে শেখর বলল

—     ভাই এখানে এমন আয়োজন করে কাজ নেই। চলো আমরা ফিরে যাই।

মদন নাছোড়বান্দা, শেখরকে একটা ধমক দিয়ে বলল

—     তাৎ ব্যাটা! এখানে কি ভূত আছে না পেতœী আছে যে ভয়ে দৌড়ে গিয়ে বউয়ের আঁচলতলে লুকিয়ে পড়তে চাচ্ছো?

আমি ওদের কথা কর্ণপাত না করে দেখলাম নিশিকান্ত দোতলায় যাবার সিঁড়ি ধরেছে। আমি নিশিকান্তকে বললাম

—     নিশি দোতলায় যাওয়া বোধহয় আমাদের ঠিক হবে না। সিঁড়ির যা অবস্থা তাতে যে কোন সময় ধ্বসে পড়তে পারে। আমার মনে হয় আমরা এই নীচতলাতেই বসি।

আমার কথা নিশিকান্ত নেমে এলো। ওর নেমে আসার সময় পায়ের ধাক্কা লেগে দুটো ইট সিঁড়ি থেকে খসে পড়লো। আমরা নিচতলার মধ্য-ঘরে ঢুকে দেখি এখানে অবস্থা খুবই খারাপ। কিছু ভাঙ্গাচোরা জিনিসপত্র পড়ে আছে মেঝেতে। আমাদের পায়ের আওয়াজ টর্চের আলো পেয়ে কয়েকটা ইঁদুর এদিক সেদিক দৌড়ে গেলো। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে এ ঘরটা একসময় জলসাঘর ছিলো। আমি মদনকে বললাম

—     মদন, আমাদের মনে হয় এখানটাতেই বসা ভালো। তুলনামূলক এ ঘরের মেঝেটা ভালো আছে।

আমার কথায় সায় দিয়ে সবাই মিলে মেঝে থেকে কিছু জঞ্জাল সরিয়ে দুটো চাদর বিছালাম। রাজু কয়েকটা পুরনো ইট এনে একটা চুলার মত ব্যবস্থা করে তাতে আগুন ধরিয়ে তার ওপরে খাসির মাংসটা কড়াইয়ে বসিয়ে দিলো। নিশিকান্ত বলল

—     চমৎকার পরিবেশ। এখন থেকে মাঝে মাঝেই এখানে আসা যাবে। সাথে তাস নিয়ে এসেছি, মাংস কষা হতে হতে একটু আধটু মদের সাথে কয়েকপ্রস্থ তাস হয়ে যাক, কী বলো অর্ঘ্য?

আমরাও দ্বিমত করলাম না। রাজু মাংসটা সামলাচ্ছে। আর এদিকে আমরা চারজন রাজুর পাশে বসেই চাদরের ওপর তাস খেলছি আর ছোট ছোট করে মদ খাচ্ছি।

আমাদের খেলা আর গল্পর মাঝে হঠাৎ করেই টের পেলাম বাড়ির দোতলায় কেউ যেন দৌড়াদৌড়ি করছে। সবার হাতের তাস হঠাৎ থমকে গেলো। কারও মুখে কোন শব্দ নেই। সবার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটানো শুরু হয়ে গেছে। আমরা তাস খেলা ছেড়ে ঘটনাটা কী ঘটেছে সেটার প্রতি মনযোগী হতেই সব শব্দ বাতাসে মিলিয়ে গেলো। শুধু চুলার ওপরে মাংস রান্নার বুদবুদে শব্দ ছাড়া আমাদের পাশে আর কোন শব্দ নেই। এমন গা ছমছমে পরিবেশে প্রথমে শেখর কাপাকাপা কণ্ঠে বলল

—     অর্ঘ্য, আমার কিন্তু ব্যাপারটা বেশি ভালো মনে হচ্ছে না। মানে মানে এবেলা আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিৎ মনে হচ্ছে।

শেখরের কথায় আমাদের নিরবতা ভাঙলেও ওর কথাটা অনেকেরই পছন্দ হলো না। সবাই কেবল মাত্র মদের বোতল খুলে বসেছে। চুলায় পাঁঠার মাংস কষানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি ছেড়ে শেখরের কথাকে যুক্তি ভেবে কেউই এখান থেকে যেতে নারাজ। মদন বলল

—     শেখরের কথা শুনেছো তোমরা? মনে হচ্ছে যেন ওর মুন্ডুটা ভূতের মুখের মধ্যে দিয়ে বসে আছে। আরে এতো কম সাহস নিয়ে বিয়ে করেছো কী করে ভায়া?

শেখরের প্রতি মদনের তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শেষ হতে না হতেই দোতলার ভাঙ্গা সিঁড়ি দিয়ে একটা বনবিড়াল মদনের কাঁধের ওপর লাফিয়ে পড়ে দরজার দিকে ছুটে চলে গেলো এবং ঘটনাটা ঘটার সাথে সাথেই মদন “ওরে বাপরে, গেলাম রে…!” বলে চিৎকার করে চারিদিক ফাটিয়ে ফেলার মত অবস্থা তৈরি করে ফেলল। এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো সাহসী ব্যক্তিও ঘাবড়ে যাবার কথা। কিন্তু যে মদন একটু আগেই শেখরকে সাহসের বাণী শুনিয়েছে তার বেলায় এমন চিৎকার করাটা একটা হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে বাধ্য। আমরা সবাই হেসে ফেটে পড়লাম যে যার মত।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাংস রান্না হয়ে গেলো। তাসখেলা রেখে এবার আমরা সবাই মাংসের কড়াইটা মধ্যখানে রেখে মদ্যপানের সাথে খাওয়া আরম্ভ করে দিলাম। মাংসটা আজ অতিরিক্ত রকমের সুস্বাদু হয়েছে। নিশিকান্ত তো রাজুকে উদ্দেশ্যে করে বলেই ফেললো

—     রাজু, আজ তোমার রান্নার হাতের প্রশংসা না করে পারছি না। লা জবাব! আজ এতো সুস্বাদু করে রান্নাটা করলে কী করে? বৌঠান শিখিয়েছে বুঝি?

রাজু উত্তর করলো

—     ভূতের বাড়িতে এসে রান্না করেছি তো। তাই ওনাদের বরেই মনে হয় সুস্বাদ চলে এসেছে।

খাওয়ার সাথে আমাদের গল্প জমে উঠেছে। সবার মুখেই আজ রাজুর রান্নার প্রসংশা। কড়াইয়ের মাংস তখন অর্ধেক শেষ। হঠাৎ শেখর বলল

—     এই দেখতো, কড়াইয়ের মধ্যখানে কালো ওটা কী?

শেখরের কথার জের ধরে রাজু কড়াইয়ের মধ্যে অনুসন্ধান চালাতে আঙুল ঢুকিয়ে দিলো কালো বস্তুটা কী সেটা দেখার জন্য। কিন্তু রাজুর হাত ধরে সেখান থেকে যে এমন একটা বস্তু উঠে আসবে তা মনে হয় কেউ কস্মিনকালেও চিন্তা করেনি। রাজুর হাত ধরে মাংসের কড়াইয়ের মধ্য থেকে একটা বড় লোমশ ইঁদুর উঠে এলো। ইঁদুরটার গায়ে মাংসের মশলা লেগে আছে এমন ভাবে যেন ওটার শরীওে পশম না থাকলে দেখে বোঝার উপায় ছিলো না যে বস্তুটা কড়াইয়ের অন্য মাংসের থেকে আলাদা। এই দৃশ্য দেখার পর যারা খাচ্ছিলাম তাদের অবস্থা বর্ণনাতীত ভাবে খারাপ হয়ে গেলো। একমাত্র আমি ছাড়া প্রত্যেকে বমি করে অস্থির হয়ে পড়েছে সাথে সাথে। আমি বমি না করলেও এই দৃশ্য দেখার পর প্রচন্ড রকমের অস্বস্তিতে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। আমি গ্লাসে বেশি করে মদ ঢেলে বড় একটা চুমুক দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম

—     সম্ভত বনবিড়ালটার মুখে ছিলো এটা। মদনের কাঁধের উপর থেকে লাফ দেবার সময় কড়াইয়ে পড়ে গেছে।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই একটা দমকা হাওয়া এসে আমাদের ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলো। হঠাৎ আমরা চারিদিকে বহু নুপুরের আর লাস্যময়ী হাসির শব্দ শুনতে আরম্ভ করলাম। আমি দ্রুত টর্চটা হাতে নিয়ে জ্বালাতে যাবো এমন সময় অন্ধকারে কেউ একজন আমার হাতে নরম একটা হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল “না…”। আমরা দ্রুত ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে ছুটোছুটি শুরু করলাম। কিন্তু অন্ধকারে দরজা খুঁজে পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ ঐ ঘরের মধ্যে ছোটাছুটির পর কীভাবে আমরা সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাম তা আমরা নিজেরাও জানি না। আমরা প্রাণপণ ছুটছি বাগানের মধ্য দিয়ে যে যার মত। ছুটতে ছুটতে আমার খেয়াল হলো সবাই আসতে পেরেছি কিনা একটু দেখা দরকার। আমি সবাইকে বললাম

—     থামো সবাই। আমরা সবাই কী আসতে পেরেছি?

আমি খেয়াল করলাম আমার হাতে টর্চটা তখনো আছে। আমি টর্চটা জ্বেলে সবার দিকে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখালাম শেখর বাদে সবাই আছে এখানে। আমি নিশিকান্তকে বললাম

—     নিশি শেখর কোথায়?

নিশিকান্তর মুখে জবাব নেই। তার মানে আমরা সবাই আসতে পেরেছি কিন্তু শেখর আসতে পারেনি।

রাজু বলল

—     অর্ঘ্য, ও মনে হয় আসতে পারেনি। আমাদের মনে হয় একটু এগিয়ে দেখা দরকার।

পেছনে এগিয়ে দেখার কথা বলতেই মদন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল

—     তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে! ঐ বাড়ির দিকে আবার?

শেখরের খোঁজে পেছনে ফিরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে রাজু আর মদনের মধ্যে রীতিমত তর্ক লেগে গেলো। শেষে সিদ্ধান্ত হলো। আমি আর রাজু শেখরের খোঁজে পিছনে যাবো আর নিশিকান্ত ও মদন এখানে অবস্থান করবে।

আমরা শেখরের খোঁজে পোড়া নটীবাড়ির দিকে রওনা হবো এমন সময় ঐ বাড়ির রাস্তার দিক ধরে শেখরের গলার আওয়াজ শোনা গেলো “অর্ঘ্য, রাজু, মদন, নিশি তোমরা কোথায়ৃ!” এবং শেখরের গলার স্বরটা ক্রমশ আমাদের কাছে আসতে লাগলো। আমি আর রাজু বার বার শেখরের ডাকের উত্তর দিতে থাকলাম “শেখর, আমরা এদিকে…”। কিছুক্ষণ পর শেখর আমাদের কাছাকাছি চলে এলো। আমি টর্চের আলোটা শেখরের দিকে ধরতেই আমরা সবাই দেখলাম শেখরে শরীরে কোন

কাপড় নেই। মাঘ মাসের এই কনকনে শীতে স¤পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় শেখর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

লোকমুখে শুনেছি ঐ বাড়িতে যারা যায় তারা আর কোনদিন ফেরত আসেনি। তবে আমরা ঐদিন কীভাবে বা কেন ফেরত আসতে পেরেছিলাম তা আমরা নিজেরাও জানি না। এই ঘটনার পর আমরা আর কখনো একসাথে বা একাকী বসে মদ খাইনি। ঐদিনের পর আমাদের মধ্যে আরও একজনের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শেখরের মধ্যে যে ভীতু ভাবটা ছিলো সেটা ঐ ঘটনার পর অদ্ভুদ ভাবে একেবারে চলে যায়। ঐদিনের পর শেখর যেন হয়ে উঠেছে অন্য জগতের এক মানুষ। সেটা কেমন মানুষ তার ব্যাখ্যা আর নাই বা দিলাম।