উত্তমকুমার পুরকাইত

ঝিরঝিরে বৃষ্টি।  আলপথ ধরে ছাতা মাথায় বিহঙ্গ বামন। বারো-চোদ্দ বছরের ছেলেরা আষাঢ়ের হাঁটুডোবা জলে ফাঁস জাল পাতছিল, একটা বক ছোঁ মেরে একটা মাছ তুলে বিহঙ্গ বামনের দিকে উড়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ একজনের চিৎকার, ঠাকুরঘরে কে রে…? বাকিরা সমস্বরে, আমি কলা খাইনি…। আর বলতে হয়নি। বিহঙ্গ ঠাকুর বুনো ষাঁড়ের মতো ক্ষেপে গেল, ছোট লোকের বাচ্চা সব, ঢেমন-ঢেমনার জাত…

  কলকলিয়ে হেসে ওঠে তোর্সা। ব্যাপারটা নিছক গল্প নয়, সত্যি। মাস খানেক আগের ঘটনা। মণ্ডলদের কাঁঠালি কলার ঝাড় থেকে ট্যাসট্যাসে এক ফিনি কলা রাধাগোবিন্দ ঠাকুরকে দিয়েছিল গিন্নিমা। পাঁচদিনের পালা। দ্বিতীয় দিনেই শেষ। মণ্ডল গিন্নি তো রেগে আগুন। সেই অগ্নিমূর্তির সামনে বিহঙ্গ বামনের ছোট ছেলে অসহায়। বাবা জ্বরে ভুগছিল বলে ছেলেই ক’দিন পূজায় আসছিল। কিন্তু লোভটা সে সামলাতে পারেনি। প্রথমে বেটা আমতা আমতা করলেও শেষমেশ স্বীকার করে। মণ্ডল গিন্নিকে এ-তল্লাটে সবাই চেনে। তুচ্ছ কারণে পাড়া মাত করে দিতে পারে। দরকারে পুলিশ-কোর্টও। ছেলেটা লজ্জায় আর পরদিন থেকে আসেনি। অসুস্থ শরীরে বিহঙ্গ বামন এলে তাকেও ছাড়েনি মণ্ডল গিন্নি। এই পাজি ছেলেগুলোও।

  ছেলেগুলো আবার চিৎকার করে, ঠাকুরঘরে কে রে…? রগচটা বিহঙ্গ বামনের অভিশাপ, গালিগালাজ আরও উচ্চৈঃস্বরে।

  তোর্সাও হাসি সামলাতে পারে না। দাঁড়িয়ে ছিল উঠানে কঞ্চির বেড়ার ধারে। জবা ফুলগাছের পাশে। ফুল তুলে ঘরে মাকালীর পায়ে দেবে বলে। না হেসে পারে না। ছেলেগুলো তেঁদড়। দেখলেই লাগে। বিহঙ্গ ঠাকুরকে যে সে অপছন্দ করে তা নয়। কিন্তু যত বয়স হচ্ছে মানুষটা কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে । ছোট ছোট ছেলেরা রাগালে ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষকে তো সংযত হতে হয়। অথচ মানুষটা কথায়-কথায় আজকাল জাতপাত তুলছে। অথচ এই মানুষটা তো তাদের বাড়িতে আসে। বাবার কাছ থেকে বিড়ি ধরায়। সুখ-দুঃখের গল্প করে। পঞ্জিকা পড়ে শুভ-অশুভ খোঁজে। মাঙ্গলিক নিদান দেয়। মানুষটা প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়, মুকুন্দ তোকে কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, তোর ছেলেটাও বড্ড বেড়েছে…

  ঠাম্মা এসে হাতজোড় করে, মাপ করে দাও বাবাঠাকুর, তুমি তো জানো ও কেমন ধারার।

  বার বার বলেছি তোমাদের, ব্রহ্মশাপ লেগে গেলে রেহাই নেই। ভট্টাচায্যিকে নিয়ে মশকরা!

  তোসার্র মুখের হাসি নিভে যায়। বামন বুড়োটার দিকে এক ঝলক কাঠ কাঠ চেয়ে সে দাওয়ায় গিয়ে ওঠে। ব্রহ্মশাপ! গ্রন্থন রায় কি তাকে অভিশাপ দিয়েছিল? যে গ্রন্থন রায়ের মুখের উপর সে বলেছিল, কেন আমাদের কাস্টে কি ছেলে নেই যে তোমাকে বিয়ে করতে হবে!

  যারা ভালবাসে তাদের জাত-অজাত থাকে না। তোমাকে ভীষণ ভালবাসি তোর্সা।

  সময় আর সুযোগ পেলে যারা আমাদের ঘেন্না করে, তারা আবার আমাদের ভালবাসে! এসব নাটক কোরো না। তুমি তোমার ক্লাস থেকে নামতে পারবে?

  কী বলছ বুঝতে পারছি না তোর্সা।

  বামুন থেকে কৈবর্ত হতে পারবে?

  গ্রন্থন রায়ের চোখজোড়া নিভে গিয়েছিল। অন্ধকার আকাশে যেন ঝটপটিয়ে উঠছিল কয়েকটা ডানা। পথ পাচ্ছে না, পথ পাচ্ছে না। কী চরম দুর্বিপাক! হা-হা করে হেসেছিল তোর্সা। নিষ্ঠুর হাসি।

  পারবে রায় থেকে নস্কর হতে?

  সেই থেকে নিরুদ্দেশ গ্রন্থন রায়। কোথায় গেল মানুষটা! ভালবাসলে কি এত সহজে হাল ছাড়ে! অথচ এই ছেলের প্রতি তো তার মায়া ছিল। গুপ্ত বংশের ইতিহাস নাগাড়ে বলতে গিয়ে যখন গুলিয়ে ফেলত, সময়ে খেইটা ধরতে পারত না, মাথার চুল মুঠোতে ধরে পাগলের মতো টানাটানি করত, হেসে লুটিয়ে পড়ত তোর্সা। তারপর যখন স্থির হত তার চোখে, একঝাঁক পাখির উড়ান দেখত সেখানে। মেঘের নৌকা দুলিয়ে ফিক করে হাসত ছেলেটা। গড়গড়িয়ে বলে যেত কালিদাস পর্যন্ত।

  মিটমিটিয়ে হাসত তোর্সা, বউকে ঠিক বাগে না পেলে সব ছেলে কিন্তু একটা সময় কালিদাস হয়ে যায়।

  অনেকবার বলেছি মুকুন্দ ও ছেলে তোমার জাতের মুখে কালি দেবে, ওকে চোখে চোখে রাখো। এই ঢেমন-ঢেমনাদের সঙ্গে মিশতে দিয়ো না।

  ও ঠাকুর বড় রেগে গেছ, একটা বিড়ি ধরাও দেখি।

  না, ছেলেকে সাইজ না করলে তোর ঘরে জল স্পর্শ নয়।

  ঠাম্মা তো নাছোড়, রাগ কোরো না বাবাঠাকুর। পায়ে পড়ি। চোখের পলকে ঠাম্মা বিহঙ্গ বামনের পায়ে।

  তোর্সা আর ঘরে থাকতে পারে না। বেরিয়ে আসে, কথায় কথায় কেন পায়ে পড়ো বলো তো ঠাম্মা, উনি তো বয়সে তোমার ছোট।

  মুহূর্তে বিহঙ্গ বামুনের মুখ পাঁশটে। ঠাম্মাকে অপরাধী দেখায়। উত্তেজিত হয়ে বলে,একটু লেখাপড়া শিখে কী যেন হয়েছিস তোরা?  বামুন হল ব্রহ্মান্ড সমান। তাঁর বয়স নয়, জ্ঞানটাই আকাশ।

  রাখো ওইসব মগজধোলাই বুলি। আর ওনার জ্ঞান আমার জানা আছে। একটা বাচ্চা ছেলে ভুল করেছে, উনি ক্ষমা করতে পারছেন না। ব্রহ্মজ্ঞান জানতে হলে চৈতন্যদেবের থেকে জানো, এসব ভেকধারী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছ থেকে নয়।

  কথাগুলো বলে ঝড় তুলে ঘরে ঢোকে তোর্সা। বিহঙ্গ বামুন থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরে মুকুন্দর দিকে তাকিয়ে বলে, ছোটঘরে মেয়েছেলে বেশি শিখলে কী হয় দেখছ তো, মহাগুরু নিপাত।

  চমকে ওঠে মুকুন্দ। বিহঙ্গ বামুন নিমেষে বাড়ি ছাড়লে চিৎকার করে, নিপাত যাক, সবকিছুর নিপাত।

  দুটো ল্যাঠামাছ ধরে এনে ভাই সামনে দাঁড়িয়ে। সবার গুম মুখের দিকে তাকিয়ে হি-হি হাসে, কী হল রে দিদি, বিহঙ্গ বামুন এসে তুক করে গেল নাকি!

  না, সবাই নিপাত যাবি। ভাইয়ের উপর রাগ দেখিয়ে তোর্সা সরে যায়।

  মহাগূরুর বাচ্চা! মাছ ধরে খাওয়াবে আমাদের, বেরো, বেরো বাড়ি থেকে। বেড়া থেকে একটা বাঁশের খেদো তুলে তাড়া করে বাবা। ভাই মাছদুটো দাওয়াতে ছুঁড়ে দিয়ে পালায়। ঠাম্মা হৈচৈ বাধায়, ওরে বাচ্চা ছেলে বলেছে বলে ওকে বকিস না। ঈশ্বরের সংসারে ওদের পাপ নেই, ওকে ডাক ডাক। একবার লুকালে কখন যে বাড়ি ফিরবে!  

  বাবা গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যায়, শুয়োরের বাচ্চাটার জন্য আমার মাথা হেঁট হয়। বাড়ি আসুক, ওর কি আমার…

  চুপ কর তো মুকুন্দ, আমিও তো হাতে পায় ধরলুম, রাগ কি পড়ল? অমন ধারার বামুন বাপু। ঠাম্মা ঘরের পিছনে বাগানের দিকে চলে যায়।

  তোর্সা বেড়া টপকে পথে এসে দাঁড়ায়। জোরে বলে, প্রহ্লাদ শুনে যা ভাই, শুনে যা।

  প্রহ্লাদ আর দাঁড়ায় না। তোর্সা ডোবার সামনে। সবেদা গাছের ডালে দুটো বুলবুলি। বেশ দেখায়। পাখিগুলোকে দেখলে গ্রন্থন রায়কে সে ওড়াতে পারে না। চশমার নীচে ভাসা ভাসা আকাশ। চারদিকে উন্মুক্ত দিগন্ত। ওখানে হারানো যায়, সহজে হারানো যায়।

  পূর্বপুরুষ যদি অপরাধ করে, আমাদের দায় কেন বলো। তাছাড়া তুমি তো জানো আমি এসব জাতপাত বিশ্বাস করি না।

  আমাকে না ভালবেসে সেই বিশ্বাসটাকে বিশ্বজনীন করতে পারবে?  চারপাশের মানুষজনকে যেদিন বোঝাতে পারবে জাতপাত, ধর্ম নামের বোগাস বিষয়গুলোকে তুমি বিশ্বাস করো না, সেইদিন তুমি আমার কেন, সারা বিশ্বের ভালবাসা পাবে।

  ওত জ্ঞান তোমাকে দিতে হবে না তোর্সা, আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমার জন্য চন্ডীদাস হতে পারি।

  আমাকে রামি ভাবছ? সেটা কিন্তু ভুল, আমি একটা বিষয় চারপাশে স্পষ্ট করতে চাই, তুমি যদি বামুন থেকে কৈবর্ত হতে পারো…

  বেশ দেখা যাক, বাজিটা কে জেতে? চলে গিয়েছিল গ্রন্থন রায়। আর ফেরেনি। পাকা তিন বছর।

  ঠাম্মাকে একদিন বলেছিল সে, একটা বামুনের ছেলে আমাকে ভালবাসে।

  খবর্দার মা, বামুনকে কৈবর্ত বানাস না, পতন হবে, তাছাড়া পুরুষরা এই সমাজটাকে একদিন গড়েছে, তাদের পতন হলে সমাজ মানবে না। কিছুতেই মানবে না। বামুনের ছেলেকে বিয়ে করে ও-পাপ করিস না মা। তোর মা নেই, আমি তোকে বলছি। ও পাপ, একেবারে পাপ।

  তোর্সা ঠাম্মার কথা শুনে খুব জোরে হেসেছিল। চিৎকার করে বলেছিল, পতন তো চাই ঠাম্মা, একটা বিশাল ধ্বস। একই সমাজে পাশাপাশি থাকা, অথচ একপক্ষের ঘৃণা, অবহেলা,  আর-এক পক্ষের থেকে ক্ষোভ, হিংসা সহ্য হয় না। সিস্টেমে একটা ব্যালান্স চাই।

  ঠাম্মা পুরোটা বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করে। বলে, খবর্দার ও-কথা আর বলিসনি। চুপ যা। এত শিক্ষে ভাল নয়, পাপ হবে, পাপ। সমাজ থেকে উচ্ছেদ হবি।

  দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোর্সা। তারপর তিন বছর। কোথায় গেল ছেলেটা! সে তো আসবে বুঝে এখনো অপেক্ষায় বসে আছে।

  বুলবুলি পাখিদুটোর একটা লেজ নাড়িয়ে পাশের ডালে লাফ দিতে, আর-একজনও তার পাশে লাফ দেয়। তোর্সার মনে হ্য় পাখিদুটো কি জোড়? একটা পুরুষ, আর-একটা মেয়ে! বুকটা তার দোল খায়। সে কক্ষনো যাবে না বামুন ফ্যামিলিতে। যারা একটু নামতে পারে না কেন যাবে তাদের কাছে? কেন এই সমাজে একটা মেয়ে বার-বার জাতে উঠতে যাবে! নস্কর, মন্ডল থেকে ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি হতে সে চায় না। সে চায় তার জাতে একজন কেউ নেমে আসুক। একজন।

  পড়া না পারায় রাত্রে ভাইকে উত্তম-মধ্যম দেয় বাবা, ঘটে বুদ্ধি নেই, এদিকে বড়-ছোট জ্ঞান নেই না? কতবার বলেছি বামুনঠাকুরের সঙ্গে লাগবি না…

  ভাই গোঁয়ার, লাগব ঠিক করব। ওই বুড়োর বড়-ছোট জ্ঞান আছে? থাকলে ঠাকমার প্রণাম নেয়! ভড়ং কোথাকার। জল পোড়া, তেল পোড়া, বশীকরণ। ঢেমনার গাছ।

  ভাইকে খুব মারে বাবা। কিন্তু অপরাধ স্বীকার করাতে পারে না। তোর্সা বাবার হাতদুটো চেপে ধরে, ও কিছু ভুল বলেনি। একদম মারবে না আর।

  বাবা উচ্চশিক্ষিত মেয়েটার দিকে বোকার মতো চেয়ে থাকে। যে মেয়েটা সেটের জন্য পড়ছে। ক’দিন পরে হয়তো কলেজের দিদিমণি হবে, তার কাছে কেমন গুটিয়ে যায়।

  তোর্সার মনটা আজ বেসামাল। বুকের ভিতরে একটা স্রোত বইছে। সেই স্রোতে হাজার ঝিনুকের ডাক। তন্নতন্ন করে সে কিছু খোঁজে। চিরকুটে একটা নম্বর। সে উঠানে নেমে আসে। সোজা ডোবার সামনে। অন্ধকারে মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে নম্বরটা। রিং বাজে।

  অতি কষ্টে যেন কেউ ধরে, পারলাম না তোর্সা। স্বপ্নটা বড় ভুল ছিল। উঁচু থেকে নীচে নামতে গিয়ে আজ আমি জুতোর দোকানে। কত মানুষের পায়ে হাত দি। অনেক চেষ্টা করে একটা চাকরি জোটাতে পারলাম না। সবাই বলে,এখন এসসি,ওবিসিদের চাকরি,সুযোগ হাতছাড়া করিস না। বাবা বলে,ওই মেয়ে চাকরি করবে, আর তুমি বসে বসে গিলবে? চণ্ডাল হতে দেব না তোমাকে।        

  বিস্ময়ে শোনে তোর্সা। বলে, হাজার বছর তো আমাদের দাবিয়ে ভোগদখল করেছ গ্রন্থন, আমরা তো মাত্র ক’দিন…। গ্রন্থন বলে,জানি।   শুনেছি তুমি নেট কোয়ালিফাই করেছ, সেটেও বসছ, আমি কিছু পারলাম না বুঝলে। তোমার কথায় এভিডেভিড করে নস্কর হতে চেয়েছিলাম, মা হেসেছিল খুব। বাবাও। বলল, তাতে কি ইতিহাস পালটানো যায়?

  সমাজটাকে কি আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইনি? এত জ্ঞান, ঐশ্বরীক ভাবনার মধ্যে কি কোনও সত্য নেই?

  কথা বলছ না কেন তোর্সা। তোমার জন্য পাগল হয়েছিলাম বলে বাবা আমাকে বাড়িছাড়া করল, অথচ তোমাকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারলাম না এ-জীবনে।

 তোমাদের ইতিহাস এত নিষ্ঠুর কেন গ্রন্থন? যে ইতিহাস এগিয়ে দেয়, সে ইতিহাস কেন পিছনে টানে? কেন তোমরা নিজেদের সমাজকে উঁচু জাত করে রাখলে? কেন হাজার হাজার বছরের পৃথিবী তোমাদের জন্য সমতল হল না?

  পারছি না তোর্সা পারছি না।

  কেন তুমি আমার কাছে আসতে পারলে না? আমি যে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম।

  মোবাইল ফোন কেটে যায়। তোর্সার যে চোখদুটো ঝিলমিল করছিল একটু আগে, এখন সেখানে গভীর,বিষন্ন সমুদ্র।