মূল: কামাল রিয়াহি
অনুবাদ: ফজল হাসান
অনেক বছর আগের কোনো একদিনের ঘটনা এবং সেই দিন ছিল আজকের মতো এমনই একটি দিন। একজন রুক্ষ চেহারার যুবক সরু রাস্তার পাশে কোনো এক ক্যাফেতে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। সে পৃষ্ঠা খোলে এবং সেখানে ছোট্ট অক্ষরে ছাপানো শিরোনাম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিরোনামটি ছিল : ‘রাজধানীতে পনের হাজার নেড়ি কুত্তা ছেকে ধরার অভিযান।’
যুবকটি হাসে এবং পড়তে শুরু করে : ‘রাজধানীর বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নতি করার মূল লক্ষ্যের অংশ হিসেবে এবং বিদেশি পর্যটকদের কাছে তিউনিসের ভাবমূর্তি ও পর্যটনের প্রধান জায়গা হিসেবে তুলে ধরার জন্য নগর পৌরসভা পনের হাজার নেড়ি কুত্তা পাকড়াও করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নগরপিতার নেতৃত্বে পৌরসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পথচারীদের বিনা ঝুকিতে এবং নির্বিঘ্নে চলাফেরা করার জন্য পুরো এলাকা থেকে বছরে আনুমানিক সাত হাজার নেড়ি কুত্তা নিশ্চিহ্ন করা হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তরফ থেকে প্রত্যেক নাগরিককে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।’
যুবকটি কাগজ ছুড়ে ফেলে দেয় এবং নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘তিউনিসে কতগুলো কুত্তা আছে?’ তারপর সে পুনরায় কাগজ তুলে নেয় হাতে এবং খবরের শেষ বাক্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সেখানে লেখা : ‘সূত্র আরো জানিয়েছে যে, এ কাজের জন্য নগর পৌরসভা বিশেষ তহবিল গঠন করেছে এবং সেই তহবিল থেকে প্রত্যেকটি কুত্তা ধরে জীবিত অবস্থায় সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিলে পুরস্কার দেয়া হবে।’
সেই রাতে যুবকটি তার বাহুতে পুরনো মোটা ছালা পেঁচিয়ে নেয়। তারপর সে ঠেলাগাড়িতে কয়েকটি চটের ব্যাগ এবং একটি পুরনো চাদর নিয়ে কুত্তা শিকারের উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। একটা সরু রাস্তার এক কোণে সে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে।
একসময় প্রথম কুত্তা ভাব নিয়ে যুবকটির দিকে এগিয়ে আসে। ওর মধ্যে কোনো চঞ্চলতা নেই এবং চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস। কুত্তাটি থামে এবং পা দিয়ে ময়লা আবর্জনার স্তূপ ঘাটতে শুরু করে। ঠিক সেই সময় যুবকটি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে কুত্তার ওপর চাদরটি ছুড়ে মারে। সে কুত্তার মাথা ভালো করে পেঁচায়, যেন কামড়াতে না পারে। তারপর সে কুত্তাটিকে চটের ব্যাগের ভেতর ভরে। কিছু সময় কুত্তাটি ভীষণ জোরে ঘেউ ঘেউ করে এবং পরে শান্ত হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কুত্তাটি কাছাকাছি এসে খুব ত্বরিৎ গতিতে ঘোরাঘুরি করছিল। প্রথমে যুবকটি ভেবেছিল যে, কুত্তাটি পাকড়াও করা সহজ হবে না। কিন্তু তারপর, সৌভাগ্যক্রমে, কুত্তাটি হঠাৎ থেমে যায়। সে পেছনের এক পা এমন জায়গায় তোলে, যেখানে ঘাপটি মেরে যুবকটি দাঁড়িয়েছিল। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়ার সময় কোনো কুত্তাই করিৎকর্মা হয় না এবং অরক্ষিত থাকে। এ ধরনের সুযোগ একবারের বেশি আসে না। যুবকটি কুত্তার ওপর চাদরটি ছুড়ে মারে এবং চটজলদি মাথা চেপে ধরে। তারপর সে কুত্তাটিকে ছোট একটা থলের মধ্যে ঢোকায় এবং অন্য কুত্তার সঙ্গে চটের ব্যাগের ভেতর ভরে।
প্রথম রাতে যুবকটি যখন ঘর থেকে বের হয়েছে, তখন সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে শেষ পর্যন্ত সাতটি কুত্তা ধরতে পারবে। সে ঘরের একটা কক্ষ খালি করে এবং সেখানে কুত্তাগুলো থাকার ব্যবস্থা করে।
পরদিন সকালে যুবকটি চটের ব্যাগ এবং চাদর দিয়ে ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে এবং বাহুতে মোটা ছালা পেঁচিয়ে নিয়ে শিকারের অভিযানে বেরিয়ে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে তার ঘরের ভেতর সত্তরটি ঘেউঘেউ করা নেড়ি কুত্তা জড়ো হয়েছে। কুত্তাগুলোর চিৎকার-চেঁচামেচির জন্য পাড়াপড়শীদের কারোরই ঘুম আসা সম্ভব নয়।
একসময় যুবকটি পুরস্কারের কথা বেমালুম ভুলে যায়। সেই সময় সে কুত্তা ধরে প্রত্যেকটির ঘাড় বাঁকা করে, যেন তাকে কামড়াতে না পারে, চটের ব্যাগের ভেতর ঢোকানোর আনন্দে বুদ্ হয়েছিল। প্রত্যেকটি কুত্তা ধরার সঙ্গে সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হচ্ছিল এবং গাণিতিকভাবে দক্ষতা বাড়ছিল। সে এমন একসময়ে পৌঁছেছে যে, কোনো কুত্তাই তার ফাঁদ থেকে পালাতে পারেনি। তখন সে একধরনের আত্মগরিমায় দেয়ালে ঘুষি দিয়ে চিৎকার করে অন্য কুত্তাদের উদ্দেশে বলে, ‘তোরা ভেবেছিস আমার হাত থেকে পালিয়ে যাবি, বেচারা কুত্তা। আগে বা পরে, তোরা সবগুলোই আমার হবি।’
ইতোমধ্যে প্রতিবেশীদের সবাই যুবকটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে। বিজ্ঞের মতো তারা নিজেদের মুখ বন্ধ রাখে। কেননা পাছে ভয় হচ্ছিল যে, ভয়ঙ্কর যুবকটি হয়তো তাদের দিকেই নজর দিবে। এখানে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সে কি কাবারিয়া এবং জেবাল আহমার এলাকার বাসিন্দাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেনি? আজ অবধি আরিয়ানা এলাকার একজনও ভুলে যায়নি তার নাম ‘আলি’, ‘কুত্তা আলি’।
অবশেষে আলি যখন নগর পৌরসভার অফিসে গিয়ে নগরপিতার সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের কথা বলে, তখন দারোয়ান তার সঙ্গে মশকরা করে এবং বলে, ‘সত্যি? তাহলে কী তুমি নগরপিতার সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করতে চাও?’
আলি মেঝেতে দাঁড়িয়ে থেকে চিৎকারের ভঙ্গিতে বারবার তার আর্জি জানায়। ‘হ্যাঁ, আমি সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি সেই লোক, যে কিনা সত্তরটি কুত্তা ধরেছে।’
দারোয়ান আলিকে টেনে-হিঁচড়ে জোর করে অফিস থেকে বের করার সময় নগরপিতা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি দারোয়ানদের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তারা বললো, ‘এই যুবকটি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। সে বলেছে, কুত্তা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবে।’
নগরপিতা আলিকে ছেড়ে দেয়ার হুকুম জারি করেন এবং তাকে তার কক্ষে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আলি কুত্তা ধরার কাহিনী বলার পর নগরপিতা আশ্চার্যান্বিত হয়ে রীতিমতো চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আমি তোমার কাজের প্রশংসা করি – আমি আশা করি প্রত্যেকটি নাগরিক যেন তোমার মতো হয়। প্রতিটি কুত্তা ধরার জন্য আমি তোমাকে দশ দিনার করে দিতে পারি। তাহলে সর্বমোট সাত শ’ দিনার হয়, যা একজন কর্মহীন মানুষের জন্য মোটেও খারাপ উপার্জন নয়। তুমি কর্মহীন, তাই না? একজন চাকরিজীবীর পক্ষে এতগুলো কুত্তা ধরা সম্ভব নয়। এই টাকা দিয়ে তুমি একটা দোকান দিতে পরো।’
‘পুরস্কারের টাকার ওপর আমাকে কত আয়কর দিতে হবে?’
যুবকের কথা শুনে নগরপিতা হাসেন। ‘না, চিন্তা করো না। তোমাকে আয়কর দিতে হবে না। এখন বলো, তোমার নাম কী?’
‘আলি। আলি এল-দীব।’
‘আলি, নেকড়ে। কুত্তা আলির মতো।’ বলেই নগরপিতা পুনরায় হাসতে থাকেন। একসময় হাসি থামিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমার পুরস্কারের টাকা নিয়ে যাও। অনেক ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।’
কিন্তু প্রস্থান করার পরিবর্তে আলি এল-দীব এক কদম এগিয়ে যায়। ‘হুজুর, আমার মনে একধরনের ইচ্ছে আছে যে, আমি একদিন পুলিশ বিভাগে যোগদান করবো। দিব্যি খেয়ে বলছি, আমি পুরস্কারের টাকা নেয়ার পরিবর্তে বরং পুলিশের চাকরি নিতে রাজি আছি, স্যার।’
এক সপ্তাহ পরে যুবকটি পুলিশের পোশাক পরে এবং হাতে প্রতিরক্ষামূলক প্যাড বাঁধে। আলি এল-দীব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুত্তাদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়। সে লাফ দিয়ে তাদের মাঝে প্রবেশ করতে চায় এবং ওরা তাকে কামড় দেয়ার চেষ্টা করে। অবশেষে প্রাণীগুলো আলিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছে: ‘কুত্তা তখনই কামড়ায়, যখন তারা সত্যিকার অর্থে কামড়াতে চায়।’
লেখক পরিচিতি: তিউনিশিয়ার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক কামেল রিয়াহির জন্ম মানাফিক গ্রামে, ১৯৭৪ সালে। তিনি একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক এবং সাহিত্য সমালোচক। তিনি দু’টো ছোটগল্প সংকলন এবং চারটি উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর ‘আল-মিসরাত’ (দ্য স্ক্যালপেল) উপন্যাস পাঠকমহলে সমাদৃত হয় এবং ‘গোল্ডেন কোমার’ পুরস্কার অর্জন করে। তাঁর লেখালেখির মূল বিষয় তিউনিশিয়ার দুস্থ-গরীব, বিপথগামী যুবসমাজ, গৃহহীন, নাবিক, পথচারি এবং সমাজের বিশেষ শ্রেণীর মানুষজনের, যেমন মুচি ও বারবণিতা, জীবনকাহিনী। তিনি ২০১০ সালে আলজেরিয়ায় শিক্ষকতা করেন এবং সেখানে থাকাকালে দিনপঞ্জি লেখেন। সেই দিনপঞ্জির জন্য তিনি ২০১৮ সালে ‘ইবনে বতুতা ইন্টরন্যাশনাল প্রাইজ ফর ট্রাভেল লিটরেচার’ পুরস্কার লাভ করেন। ইতোমধ্যে তাঁর লেখা সাহিত্য ইংরেজি, ফরাসি, ইতালি এবং হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। চল্লিশ বছরের কম বয়সী আরব বিশ্বের অন্যতম লেখক হিসেবে তিনি ২০০৯-১০ সালে ‘হে ফেস্টিভ্যাল’-এর ‘বৈরুত৩৯ প্রজেক্ট’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।
গল্পসূত্র: ‘কুত্তা শিকার’ কামেল রিয়াহির ইংরেজিতে ‘ডগ হান্টিং’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি আরবি থেকে ইংরেজিতে তরজমা করেছেন ইলিয়ট কোলা। ইংরেজিতে গল্পটি ‘জাদালিয়া’ ম্যাগাজিনে ২০১২ সলের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘কুত্তা শিকার’ গল্পটি লেখকের আরবিতে ‘দার আল-সাকি’ (ইংরেজিতে ‘দ্য গরিলা’) উপন্যসের চুম্বক অংশ। গল্পটি প্রতীকধর্মী এবং নেড়ি কুত্তা হিসেবে অপাঙ্ক্তেয় নাগরিকদের বোঝানো হয়েছে, যা নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বাধা স্বরূপ।